News Bangladesh

যশোর সংবাদদাতা || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৭:৫৬, ২৩ আগস্ট ২০২৫
আপডেট: ২০:৩২, ২৩ আগস্ট ২০২৫

৪২ বছর ধরে জলাবদ্ধতায় ভুগছে ভবদহ পাড়ের ১২ লাখ মানুষ

৪২ বছর ধরে জলাবদ্ধতায় ভুগছে ভবদহ পাড়ের ১২ লাখ মানুষ

ছবি: নিউজবাংলাদেশ

যশোর ও খুলনা জেলার ভবদহ অঞ্চলের প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে এক ভয়াবহ জলাবদ্ধতার শিকার। 

যশোর জেলার মণিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, যশোর সদর এবং খুলনা জেলার ডুমুরিয়া, কয়রা, ফুলতলা ও বটিয়াঘাটার প্রায় ৫৫টি গ্রাম এই জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এতে ১ লক্ষ ২৮ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যার ফলে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন ও স্থানীয় অর্থনীতি।

১৯৫৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের শাসনামলে ‘সবুজ বিপ্লব’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা দূর করতে একটি বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। 

এই প্রকল্পের আওতায় ২৭টি বিলের পানি নিষ্কাশনের জন্য মণিরামপুর উপজেলার টেকা-মুক্তেশ্বরী নদীর উপর ভবদহ সুইচ গেট তৈরি করা হয়। ১৯৬২ সালে খাল খননের কাজ শুরু হয়ে ১৯৬৩ সালে শেষ হয়। এতে করে দ্রুতই পানি নিষ্কাশন সম্ভব হয় এবং প্রায় দুই দশক ধরে এই এলাকা ছিল শস্য-শ্যামল ও প্রাণবন্ত।

কিন্তু ১৯৮২ সালে প্রথম বিপর্যয় ঘটে। সুইচ গেটের গেটগুলোতে পলি জমে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে শুরু করে, যা জলাবদ্ধতার জন্ম দেয়। 

প্রথম দিকে মণিরামপুরের নেহালপুর ও কুলটিয়া ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ধীরে ধীরে এই সমস্যা বিস্তৃতি লাভ করে এবং যশোর-খুলনার ১২ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করে।

দীর্ঘ ৪২ বছরে বিভিন্ন সরকার পরিবর্তন হলেও ভবদহবাসীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং এই অঞ্চলের দুর্দশাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক নেতা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রকল্পে আরও অর্থ বরাদ্দ করা হয়। ২০০১-০২ অর্থবছর থেকে ২০০৪-০৫ অর্থবছর পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ২২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।

আরও পড়ুন: খুলনায় জবাই ক‌রে যুবক‌কে হত্যা

সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কয়েক বছর আগে কাজ শুরু হলেও খাল খননের মাটি বিলের খালে পড়ার কারণে পানি প্রবাহ আবারও বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধান হয়নি।

ভবদহ সুইচগেট, যা ২৭টি বিলের পানি নেহালপুর ইউনিয়নের কেদারিয়া নদীর মাধ্যমে টেকা-মুক্তেশ্বরী নদী দিয়ে সাগরে নিয়ে যেত, বর্তমানে প্রায় নষ্ট। এখানে আগে ২১টি, ৯টি, ৬টি, ৪টি, ৩টি ও ১টি করে গেট ছিল।

স্থানীয় ভুক্তভোগীরা জানান, গত কয়েক বছর আগে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কিছু কাজ শুরু হলে কিছুটা আশার আলো দেখা গিয়েছিল। তবে খাল খননের মাটি সঠিকভাবে অপসারণ না করায় তা আবার খালে ফিরে আসে এবং পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে সমস্যা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে।

অভয়নগরের বাসিন্দা ভবতোষ জানান, ছোটবেলা থেকে তিনি শুধু শুনেই এসেছেন যে ভবদহের সমস্যার সমাধান হবে, কিন্তু তা আর হয় না। প্রতিবার বাজেট আসে, কিন্তু সেই টাকার সামান্য কাজ করে সরকারি কর্মকর্তা ও নেতাদের পকেট ভারী হয়, এলাকার মানুষের কোনো কল্যাণ হয় না।

কৃষক জালাল উদ্দিন বলেন, ৩০ বছর আগে এই এলাকায় প্রচুর ফসল ফলতো। কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে ফসল না হওয়ায় কৃষকরা এখন জমিতে মাছের ঘের তৈরি করেছেন, যার ফলে পানি নিষ্কাশন আরও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জলাবদ্ধতা এখন মানুষের বাড়িঘর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।

পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, সরকার আসে আর যায়, কিন্তু ভবদহবাসীর সমস্যার সমাধান হয় না। বরাদ্দকৃত টাকা জনগণের কল্যাণে আসে না, বরং আমলা, রাজনীতিবিদ ও ঠিকাদারদের পকেটেই যায়। 

তিনি আরও বলেন, সুইচ গেট নির্মাণের সময় একজন প্রকৌশলী ২০-৩০ বছরের মধ্যে এর কুফল দেখা দেওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, যা এখন সত্যি হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জি সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। 

তিনি বলেন, তারা ভবদহ অঞ্চলের সব নদী ও খাল পুনঃখননের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫টি নদীর ৮১.১৫০ কিলোমিটার পুনঃখননের জন্য ইতোমধ্যে ১৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই কাজের দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের তত্ত্বাবধানে খুব শিগগিরই কাজ শুরু হবে। 

তিনি আশা করেন, এই কাজ সমাপ্ত হলে এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখ-দুর্দশা ঘুচে যাবে।

ভবদহ অঞ্চলের মানুষ এখন নতুন এই প্রকল্পের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা আশা করে, এবারের উদ্যোগটি সফল হবে এবং ৪২ বছরের দুর্ভোগের অবসান ঘটবে।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়