গণমানুষের নেতা ‘লাল মওলানা’
মওলানা ভাসানী। সংগৃহীত ছবি
১৯৭৬ সালের এই দিনে (১৭ নভেম্বর) বঙ্গীয় এ দ্বীপে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে দাফন করা হয়। আফ্রো, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার মেহনতি বুভুক্ষু মানুষের অধিকার আদায়ের পথিকৃৎ মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী।
কিন্তু দুঃখের বিষয় দিন বদলের সাথে সাথে আমরা গণমানুষের অধিকার আদায়ে সদা সোচ্চার থাকা এই মহান নেতাকে ভুলতে বসেছি। তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীর দিনগুলোতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তেমন কোনো কর্মসূচি চোখে পরে না। তাছাড়া, মওলানা ভাসানীর নামের সাথে যুক্ত ‘মওলানা’ শব্দটিকে কোথাও মাওলানা এবং কোথাও মৌলানাও লিখতে দেখা যায়। যা জনমনে বিশেষ করে ভবিষ্যত প্রজন্মের মনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ করতে পারে। এসব বিষয়ে সতেচত মহলসহ সরকারকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি
মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ১৭ নভেম্বর টাঙ্গাইল পৌর শহরের সন্তোষে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল, ভাসানী ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সমাজিক সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৭টায় মওলানা ভাসানীর মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং মোনাজাতের মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. আনোয়ারুল আজীম আখন্দ। এরপর ভাসানীর পরিবার, রাজনীতিক দল, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও মওলানা ভাসানীর মুরিদান, ভক্ত, অনুসারীরা মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং মোনাজাত করবেন। এছাড়াও দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভা, মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, এতিম ও দুঃস্থদের মাঝে খাবার পরিবেশন করা হবে।
ভাসানী ফাউন্ডেশনের মহাসচিব মাহমুদুল হক সানু জানান, ‘মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সন্তোসে ভাসানী ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে (১১-১৭) নভেম্বর পর্যন্ত ৭দিন ব্যাপী ভাসানী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলার মুক্ত মঞ্চে প্রতিদিন আলোচনা সভা সন্তোষে মওলানা ভাসানীর মাজার প্রাঙ্গনে ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট ফরহাদ ইকবাল গণমাধ্যমকে জানান, মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সোমবার সকাল ১১টায় ভাসানীর মাজার প্রাঙ্গনে জেলা বিএনপির উদ্যোগে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।
মেহনতি মানুষের নেতা সম্পর্কে বেশকিছু অজানা তথ্য-
১. "নামাজ হইতে আসিয়া হুজুর কোরবাণির হুকুম দিলেন। ময়মনসিংহের সৈয়দ শরফুদ্দীন হাবীব একটি গরু পাঠাইয়াছিলেন। মুরিদদের কেউ কেউ খাসী দিয়াছিলেন। সব জবেহ হইল। হুজুর কাহাকেও গোশত দেন না। পাক করাইয়া একসাথে সবাইকে খাওয়াইয়া দেন। পাকের মশলার অভাবে অনেক গরীব গোশত বিক্রয় করিয়া দেয়। অথবা কোন রকম সিদ্ধ করিয়া খায়। তাই হুজুর খিচুড়ী ও গোশত খাওয়ান। হুজুরের বাড়িতে একটা কুকুর থাকিত। এক টুকরা ভাল গোশত কুকুরটাকে নিজেই খাইতে দিলেন।
বলিলেন, নাড়ি-ভুড়ি তো খাবেই। কিন্তু কোরবানীর গোশতের হিস্যা হিসাবে এইটা। দুপুরে হাজার হাজার লোকের জমায়েত হইল। সবার হাতে কলাপাতা। দশের হাতে শিগগির পাকও হইয়া গেল। গরু খাসী যাহা পাক হইল সবই খাওয়ানো হইল। আমরাও কিছু খাইতে পাইলাম বটে।
রাত্রে অবিশ্বাস্য হইলে সত্য- হুজুর ও আমরা ডাল ভর্তায় ভাত খাইলাম। খাইতে বসিয়া হুজুর বলিলেন, একটা ভুল হইয়া গেল রে। বাবুর মার (স্ত্রী) লাগি আমাদের কোরবানীর তরকারি তো রাখা হইল না। তারপর নিজেই বলিলেন, ঠিক আছে, কাল নানান জায়গা তনে (থেকে) তো তরকারি আসবই।"
১৯৭৬ সালের ১৬ মে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ পর্যন্ত ফারাক্কা লংমার্চের নেতৃত্বে তিনি।
২. "মওলানা সাহেবকে ১৯৭৬ সালে যখন পিজি হাসপাতাল থেকে উঠিয়ে নেয়া হয় তখন তাঁর শরীরে ছিল আগুনের মত জ্বর। তাঁকে যখন রাজশাহী পর্যন্ত নেয়া হল। দেখা গেল তাঁর শারীরিক অবস্থার ভয়ংকর রকম অবনতি ঘটেছে। অনেকে মনে করলেন তাঁকে নিয়ে আর টানা হেঁচড়া করা ঠিক হবে না। সকলের মধ্যে একটা দোদুল্যমান মনোভাব দেখা দিল। তাঁর শরীরের এই অবস্থা, তার ওপর তুমুল বৃষ্টি।
এই ধরনের আবহাওয়ায় মওলানাকে সীমানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই সকলে গড়িমসি করছিলেন। মাওলানা সাহেবকে ব্যাপারটি জানানো হলে তিনি সেই প্রকান্ড হুঙ্কারটি ঝেড়ে দিলেন- ‘কি মনে কর মিঞা, তোমাগো শরীরে মানুষের রক্ত নি আছে! চল, সামনে চল।’ অতএব আবার লং মার্চ শুরু হল। যেতে যেতে যখন সীমার্ন্তের নিকটবর্তী কানসাট গ্রামটিতে মিছিল এসে থামল মাওলানার অবস্থা তখন সঙ্গিন। . . . .এরকম সংজ্ঞালুপ্ত অবস্থায় তিনি দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে কানসাটের জনসভাটিতে বজ্র কঠোর কন্ঠে গুরুগম্ভীর ভাষায় দেড় ঘন্টাব্যাপী জীবনের শেষ বক্তৃতাটি কিভাবে তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, লং মার্চের অংশগ্রহণকারীরা এটাকে একটা আশ্চর্য ঘটনা বলে মনে করেন।
মওলানা তাঁর বক্তৃতায় বলেন- ‘গঙ্গার পানি আমাদের ন্যায্য হিস্যা, এটা আমাদের প্রাকৃতিক অধিকার, এই অধিকার মানুষের একার নয়, পশু-পাখি, গাছপালা, কীটপতঙ্গ প্রাণবান সবকিছুর একান্ত জন্মগত অধিকার। যারা এই অধিকার হরণ করছে তারা প্রাণের বিরুদ্ধে জুলুম করছে। ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে এই অঞ্চলে প্রাণের বিকাশ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে চাইছে। বাংলাদেশের প্রাণবান মানুষ এই জুলুম কিছুতেই মেনে নিতে পারে না এবং ভারত জুলুমবাজি করে শেষ পর্যন্ত কোনদিনই জয়যুক্ত হতে পারে না।’
৩. ১৯৪৭ সালে মওলানা ভাসানী গেছেন টাঙ্গাইলের জমিদার গোপেশ্বর সাহা রায় চৌধুরীর বাড়ি। জমিদার গোপেশ্বর রায় প্রজা বৎসল ছিলেন। গরীব-দুঃখীর সাহয্য ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আলোপ আলোচনা করছিলেন। মাগরিবের সময় হলে তিনি গোপেশ্বর রায় চৌধুরীর কাছে নামাজের জায়গা চাইলেন। গোপেশ্বর বাবু হেসে বললেন, ‘হিন্দু বাড়িতে নামাজ পড়লে নামাজ হবে কী মওলানা সাহেব?’
গোপেশ্বর বাবুর কথা শুনে মওলানা জবাব দিলেন, ‘আল্লাহ সব জায়গায় বিরাজমান, তবে কি হিন্দু বাড়িতে থাকে না?’ মওলানার জবাব শুনে গোপেশ্বর বাবু ‘থ’ হয়ে গেলেন, উচ্চারণ করে বললেন, ‘হুজুর, আপনার মত উদার মনের মানুষ যদি সবাই হতো তাহলে কেউ সম্প্রদায়িকতার আগুনে জ্বলতো না।
একনজরে মওলানা ভাসানী
নাম: আবদুল হামিদ খান ভাসানী (মওলানা ভাসানী)
ভাসানী নামকরণ: আসামে কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকেই তার নাম রাখা হয় "ভাসানীর মাওলানা"। পরবর্তীতে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়।
ডাক নাম: লাল মাওলানা, চেগা মিয়া
উপাধি: মজলুম জননেতা
জন্ম: ১২ ডিসেম্বর ১৮৮০
জন্মস্থান: ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির পাবনা জেলার সয়াধানগড়া পল্লী। বর্তমানে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলায়।
পিতা: হাজী শারাফত আলী খান
মাতা: মোসাম্মৎ মজিরন বিবি (বেগম শারাফত আলী)
পির: ইরাকের আলেম ও ধর্মপ্রচারক সাইয়্যেদ নাসির আদ-দ্বীন আল-বাগদাদি
শিক্ষা: পির নারিরুদ্দীনের কাছে ধর্মীয় শিক্ষার পর দারুল উলুম দেওবন্দ রাজনীতির অনুপ্রেরণা: দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস
প্রথম কারাভোগ: ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদানের অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় দশ মাস কারাদণ্ড
রাজনৈতিক দায়িত্ব: চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ্য পার্টি সংগঠিত করা।
বিয়ে: জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন মহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে করেন
জাতীয়তা: ব্রিটিশ ভারতীয় (১৮৮০–১৯৪৭), পাকিস্তানি (১৯৪৭-১৯৭১), বাংলাদেশি (১৯৭১–১৯৭৬)
আন্দোলন: আসামে কৃষক-প্রজা আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, বাংলা ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফারাক্কা লং মার্চ
সভাপতি: আওয়ামী লীগ (সর্ব প্রথম)
রাজনৈতিক দল: ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), রাজনৈতিক দল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ
নিখিল ভারত মুসলিম লীগ, স্বরাজ দল, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
মওলানা ভাসানী রাজনীতির পাশাপাশি জয়পুরহাট-এর পাঁচবিবিতে মহিপুর হক্কুল এবাদ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন যার অধীনে একটি মেডিকেল, টেকনিক্যাল স্কুল, হাজী মুহসিন কলেজ (প্রস্তাবিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করেন, পরে সেটি জাতীয়করণ করা হয়। বর্তমানে এটি মহীপুর হাজী মহসীন সরকারি কলেজ নামে পরিচিত। কলেজটিতে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ে কোর্স চালু আছে। তিনি সন্তোষে কারিগরী শিক্ষা কলেজ, শিশু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ছাড়াও কাগমারিতে মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ, সন্তোষে "সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়" নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন- পরবর্তীতে যেটি ২০০২ সালে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া আসামে ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন মওলানা ভাসানী।
মৃত্যু: ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬ (বয়স ৯৫)
সমাধিস্থল: সন্তোষ, টাঙ্গাইল
তথ্যসূত্র: সৈয়দ আবুল মকসুদ, আহমদ ছফা ও উইকিপিডিয়া
নিউজবাংলাদেশ.কম/এনডি








