আমি জামায়াতের কেউ নই, তবু কেন মনে হচ্ছে—এই সমাবেশ ইতিহাসের বাঁক ঘোরাবে?

ছবি: নিউজবাংলাদেশ
আমি জামায়াতে ইসলামীর কেউ না। এই দলের আদর্শ, অতীতের রাজনৈতিক ভূমিকা কিংবা সহিংস আন্দোলনের ইতিহাস—সবই আমার জানা। বরং বলা যায়, তাদের বেশিরভাগ অবস্থানের সঙ্গে আমি মতাদর্শিকভাবে দ্বিমত পোষণ করি। তবুও আজ, যখন তারা "সর্ববৃহৎ সমাবেশ" করতে যাচ্ছে, তখন আমার ভিতরে এক অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে। প্রশ্ন জাগে—কেনো?
এমন তো নয় যে, আমি হঠাৎ করেই তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছি। বরং আমি বিষয়টিকে দেখছি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, জনগণের হতাশা, বিকল্পহীনতা এবং রাজনৈতিক স্পেস সংকোচনের একটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে।
১. বিকল্পহীনতা আর রাজনীতির শূন্যতা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠ দীর্ঘদিন ধরে দুই প্রধান শিবিরের একঘেয়ে দ্বন্দ্বে ক্লান্ত। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নামক দুটি মেরুর মাঝখানে সাধারণ জনগণ বারবার অসহায় হয়ে পড়েছে। রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠেছে বিদ্বেষ, গালাগাল, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লড়াই। এই পরিস্থিতিতে বহুদিন পর জামায়াত যদি লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েত ঘটাতে পারে—তা নিছক দলের সাংগঠনিক শক্তির প্রকাশ নয়, বরং জনগণের মনস্তত্ত্বের দিকেও ইঙ্গিত করে।
২. সমাবেশটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি এক প্রকার গণভোট: এই সমাবেশের সফলতা বা ব্যর্থতা শুধু জামায়াতের জনপ্রিয়তা মাপার মাপকাঠি নয়, বরং এটা বর্তমান শাসনব্যবস্থার প্রতি জনমনের আস্থার সূচক হিসেবেও দাঁড়াতে পারে। মানুষ হয়তো দল হিসেবে জামায়াতকে গ্রহণ করছে না, কিন্তু তারা যদি রাজপথে সক্রিয় কোনো শক্তি খুঁজে পায় আর তা তাদের কণ্ঠস্বর হতে পারে, তাহলে সেটাও ভয়ংকর এক বার্তা।
৩. রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রতিবিম্ব: দীর্ঘদিন জামায়াত রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ, নেতারা কারাগারে বা আত্মগোপনে, দলীয় নিবন্ধন বাতিল। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী আবার প্রান ফিরে পায় দলটি। আজ তারা প্রকাশ্যে সমাবেশ করছে, অনুমতি পাচ্ছে বা আদায়ে সক্ষম হচ্ছে—এ থেকেই বুঝা যায়, রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আদর্শ বা সংগঠনকে চিরতরে দমন করা যায় না, যদি না সেই আদর্শের জবাবে বিকল্প আদর্শ গড়ে ওঠে। ক্ষমতাসীন শক্তি যখন নিজেই আদর্শিক দেউলিয়াত্বে ভোগে, তখন নিষিদ্ধ ঘোষিত শক্তিও ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হয়ে উঠতে পারে জনগণের চোখে।
৪. জামায়াতের পরিবর্তনের কৌশল: জামায়াত এখন কৌশল পাল্টাচ্ছে। ইসলামী রাজনীতির কঠোর ভাষা নয়, বরং গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো বিষয়কে সামনে আনার চেষ্টা করছে। প্রশ্ন হলো—এটা কি তাদের সত্যিকার আদর্শগত বিবর্তন, নাকি কেবল সময়ের চাহিদা মেটানোর ছলচাতুরি? উত্তর যা-ই হোক, এই নতুন কৌশল রাজনীতির মাঠে নতুন ব্যাখ্যা দাবি করে।
৫. আমার দৃষ্টিভঙ্গি: আমি শুধু একজন পর্যবেক্ষক। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নই। আমি কেবল একজন নাগরিক, যে তার চারপাশের ঘটনা দেখে, বোঝে, প্রশ্ন তোলে। আমি জামায়াতকে ভয় পাই, যেমন ভয় পাই ফ্যাসিবাদী মনোভাব, অসহিষ্ণুতা, মৌলবাদ। কিন্তু একইসঙ্গে আমি সেই বাস্তবতাকেও ভয় পাই, যেখানে মানুষের রাজনৈতিক কণ্ঠরোধ করা হয়, বিকল্প শক্তিগুলো নিশ্চিহ্ন করা হয়, এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হয়।
এই সমাবেশ যদি সত্যিই "সর্বকালের সেরা" হয়ে ওঠে, তাহলে সেটা জামায়াতের কৃতিত্ব নয় শুধু, বরং বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি ব্যর্থতার প্রতিফলন। মানুষ বিকল্প খুঁজছে—এবং সেই শূন্যতা পূরণ করতে যে-ই এগিয়ে আসুক, তাকে আমরা অবজ্ঞা করতে পারি না।
শেষ কথা: আমি জামায়াতের কেউ নই, তাদের অনেক কিছুর বিরোধিতাও করি। কিন্তু তাদের সমাবেশ নিয়ে যে আলোড়ন সমাজে ও আমার নিজের মনেও সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। এই ঘটনা আমাদের সামনে একটি আয়না ধরছে—আমরা কি দেখার সাহস রাখি?
লেখক: কবি, গীতিকার, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
নিউজবাংলাদেশ.কম/এসবি