News Bangladesh

শফিউল বারী রাসেল || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৩:৪৪, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

জয়পুরহাট থেকে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার বাস্তবতা

জয়পুরহাট থেকে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার বাস্তবতা

প্রতীকী ছবি

ভূমিকা: সত্য প্রকাশের দায়িত্ব নেওয়া সাংবাদিকদের ওপর ভয়ভীতি, মিথ্যা মামলার হুমকি বা শারীরিক আক্রমণ—এসব কেবল ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নয়; সামগ্রিকভাবে মুক্ত সংবাদমাধ্যম ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ওপর আঘাত। জয়পুরহাটের ঘটনাটি দেখায়, স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীন/প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কীভাবে সংবাদকর্মীদের চাপে রাখার কৌশল নেন। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পরিসংখ্যান, আন্তর্জাতিক সূচক, এবং আইনগত কাঠামোর আলোকে বিশ্লেষণ করা হলো।

সাম্প্রতিক চিত্র: তথ্য-উপাত্ত
১. নির্বাচন কভারেজে সহিংসতা (৭ জানুয়ারি ২০২৪): অন্তত ১৮ জন সাংবাদিক আক্রমণ ও হয়রানির শিকার হন—এটি নির্বাচনী সময়ে সংবাদকর্মীদের ঝুঁকির প্রকট উদাহরণ।

২. কোটা আন্দোলনের সময় (জুলাই ২০২৪): মাঠে রিপোর্টিং করতে গিয়ে একাধিক সাংবাদিক নিহত/আহত হওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

৩. মধ্য–২০২৪-এর হিসাব: ARTICLE 19 জানায়—২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় ২৩২টি লঙ্ঘন নথিভুক্ত, যার প্রভাব পড়ে ৩৩৭ জন সাংবাদিকের ওপর; সাইবার সিকিউরিটি আইন ব্যবহার করে সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করার প্রবণতাও দেখা যায়।

আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান: রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডার্স (RSF)–এর ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০২৫–এ বাংলাদেশ ১৬টি ধাপ উন্নীত হয়ে ১৪৯তম অবস্থানে—যা প্রবণতিগত উন্নতির ইঙ্গিত দিলেও, সামগ্রিকভাবে এখনো নীচের সারিতেই। RSF–এর দেশের প্রোফাইল বলছে, প্রধান জাতীয় দৈনিকগুলো কিছু স্বাধীনতা বজায় রাখলেও চাপ, হয়রানি ও স্ব-নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি বিদ্যমান।

আইনগত কাঠামো: সুরক্ষা নাকি নিয়ন্ত্রণ?
সংবিধান: বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকৃত; তবে আইনের যথোপযুক্ত সীমাবদ্ধতা সাপেক্ষে। (প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ দেখুন: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পজিশন পেপার)

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (DSA) → সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট (CSA) ২০২৩: সরকার ২০১৮ সালের DSA বাতিল করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ২০২৩ প্রণয়ন করে। বহু ধারায় শাস্তি কমালেও, কাঠামোগতভাবে বহু বিতর্কিত বিধান বজায় থাকায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় আশঙ্কা অব্যাহত—এমন মূল্যায়ন রয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর।

জাতিসংঘ মানবাধিকার দফতর (OHCHR): DSA–র অপপ্রয়োগ নিয়ে ২০২৩ সালে তীব্র উদ্বেগ জানিয়ে অবিলম্বে স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছিল এবং পরে নতুন CSA নিয়েও যথেষ্ট সংশোধনের সুপারিশ করেছে।

সাম্প্রতিক নীতিগত পরিবর্তন (২০২৫): সংবাদমাধ্যমে এসেছে—অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে সাইবার সিকিউরিটি আইন ২০২৩– এর কিছু বিতর্কিত ধারা বাতিল এবং ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার খসড়া—যা বাস্তবায়িত হলে মতপ্রকাশের পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। (সংবাদ প্রতিবেদন)

হুমকি–ধমকির শাস্তি ও দণ্ডবিধি: ব্যক্তিকে ভয় দেখানো/হত্যার হুমকি দেওয়ার মতো অপরাধের বিচার বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০–এর অধ্যায় XXII–এ বর্ণিত। ধারা ৫০৩–এ “Criminal Intimidation”–এর সংজ্ঞা এবং ধারা ৫০৬–এ শাস্তি নির্ধারণ আছে (কারাদণ্ড/জরিমানা/উভয়ই)।

সমস্যার ধরন স্থানীয় থেকে জাতীয়: জয়পুরহাটের মতো ঘটনায় আমরা সাধারণত দেখি—
১. স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি/পেশাজীবীর ফোনে হুমকি, মিথ্যা মামলার ভয়;

২. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল/ডক্সিং,

৩. আইনগত হয়রানি (বিশেষত সাইবার–আইনের ধারা ব্যবহার),

৪. মাঠে রিপোর্টিংয়ের সময় শারীরিক হামলা।

এই চারটি স্তরের যেকোনো একটির পুনরাবৃত্তি সামগ্রিকভাবে সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা–ঝুঁকি ও স্ব-নিয়ন্ত্রণ (self-censorship) বাড়ায়—যার প্রতিফলন আন্তর্জাতিক সূচক ও ক্ষেত্রসমীক্ষায় ধরা পড়ে।

তুলনামূলক প্রেক্ষাপট: দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণমাধ্যমের ওপর বহুমাত্রিক চাপ বেড়েছে—আঞ্চলিক রিপোর্টগুলোতে সাংবাদিক–নিরাপত্তা, ইন্টারনেট শাটডাউন, আইনি হয়রানির উল্লেখ রয়েছে।

কী করা যেতে পারে: নীতি ও প্র্যাকটিস

আইনি সংস্কার: 
১) CSA–র স্পষ্ট সংজ্ঞা, ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়া, গ্রেপ্তার–পূর্ব সুরক্ষা এবং সাংবাদিকতামূলক কাজের পাবলিক ইন্টারেস্ট ডিফেন্স সংযোজন। 

২) দণ্ডবিধির ৫০৩/৫০৬ ধারায় হুমকি–মামলায় দ্রুত তদন্ত ও প্রসিকিউশন নিশ্চিত করা।

প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা:
১) জেলা প্রশাসন/পুলিশকে জিডি থেকে চার্জশিট পর্যন্ত একটি টাইম বাউন্ড SOP দিতে হবে—সাংবাদিক–হুমকির কেসে ৩০ দিনের মধ্যে অগ্রগতি–রিপোর্ট বাধ্যতামূলক। (নীতিগত সুপারিশ)

২) প্রেসক্লাব/ইউনিয়নগুলোতে লিগ্যাল এইড সেল ও ইনসিডেন্ট রিপোর্টিং হটলাইন। (প্র্যাকটিস গাইডলাইন)

সেফটি ও ডিজিটাল সিকিউরিটি:

১) মাঠে রিপোর্টিংয়ের জন্য ট্রেনিং, রিস্ক–অ্যাসেসমেন্ট চেকলিস্ট, এস্কেপ–রুট, ‘বাডি সিস্টেম’। (CPJ সেফটি রিসোর্স অনুসরণযোগ্য)

২) অনলাইন হয়রানির ক্ষেত্রে ডকুমেন্টেশন–এভিডেন্স প্রিজারভেশন, জরুরি আইনি সহায়তা এবং প্ল্যাটফর্ম–রেসপন্স টিম। (ARTICLE 19–এর সুপারিশ)

নৈতিকতা ও জবাবদিহি: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা বিধিতে শিক্ষকের পেশাগত আচরণ–সংক্রান্ত স্পষ্ট গাইডলাইন; শিক্ষার্থী নির্যাতন/সাংবাদিক হুমকির অভিযোগে শোকজ→তদন্ত→শাস্তি প্রটোকল প্রকাশ্য করা। (নীতিগত সুপারিশ)

উপসংহার: জয়পুরহাটের ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন নয়; এটি এমন এক পরিবেশের অংশ, যেখানে সত্য বলার দায় বহন করা ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। পরিসংখ্যান ও আন্তর্জাতিক সূচক দেখায়—আইনগত কাঠামো, প্রয়োগ ও রাজনৈতিক আচরণে সংস্কার ছাড়া স্থায়ী উন্নতি সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে RSF সূচকে কিছু অগ্রগতি এবং বিতর্কিত সাইবার ধারাগুলো সংস্কার/বাতিলের ইঙ্গিত ইতিবাচক; তবে ভারসাম্য রক্ষার একমাত্র পথ হলো আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও দ্রুত প্রতিকার। সাংবাদিকের নিরাপত্তা মানেই জনগণের তথ্য–অধিকার রক্ষা—এটি রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও সমাজ—সব পক্ষের যৌথ দায়িত্ব।

লেখক: শফিউল বারী রাসেল (কবি, গীতিকার, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষক)

নিউজবাংলাদেশ.কম/এসবি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়