News Bangladesh

নিউজ ডেস্ক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ১৪ জুলাই ২০২৫

বিচার ও বিজয়ের সংকল্পে ‘জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ’ উদ্বোধন

বিচার ও বিজয়ের সংকল্পে ‘জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ’ উদ্বোধন

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান’-এ শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধন হলো নারায়ণগঞ্জে। 

সোমবার (১৪ জুলাই) বিকেলে হাজীগঞ্জ এলাকায় আয়োজিত এক আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাঁচজন উপদেষ্টা এ স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধন করেন। 

শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তারা ঘোষণা দেন, চলমান বিচারপ্রক্রিয়া এ সরকারের মেয়াদেই সম্পন্ন করা হবে।

এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থানে নারায়ণগঞ্জে শহীদ হওয়া ২১ জন তরুণের নামে। স্মৃতিস্তম্ভের ফলকে তাদের নাম স্থায়ীভাবে খোদাই করা হয়েছে। 

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শহীদ পরিবারের সদস্য, আহত আন্দোলনকারীরা, স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন।

উপদেষ্টাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, শিল্প ও গৃহায়ন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, রেলপথ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের লোকদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, অঙ্গহানি করা হয়েছে—এ বিচার কোথায়? আমি দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই, বিচার অগ্রসর হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণহত্যার বিচার সম্পন্ন হবে এ সরকারের শাসনামলেই।

তিনি আরও জানান, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় দায়েরকৃত মামলাগুলোর চার্জশিট ৫ আগস্টের মধ্যে দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে মামলাগুলোর নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া শুরু হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।

আন্দোলনের ঐক্যের কথা স্মরণ করে আসিফ নজরুল বলেন, আমরা জুলাইয়ে বিজয়ী হয়েছিলাম, কারণ আমরা একটি পরিবারে পরিণত হয়েছিলাম। সেই ঐক্য আমাদের ধরে রাখতে হবে, চাঁদাবাজ ও লুটেরাদের বিরুদ্ধেও একসঙ্গে রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রশাসন এতে সহায়তা করবে।

আরও পড়ুন: গণভবন এখন ‘জুলাই স্মৃতি জাদুঘর’: উদ্বোধন ৫ আগস্ট

শিল্প ও গৃহায়ন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, এই স্মৃতিস্তম্ভ ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের স্মারক। আমরা গণভবনকে একটি ‘ফ্যাসিস্ট জাদুঘর’ হিসেবে গড়ে তোলার কাজ করছি, যা ৫ আগস্টের মধ্যে উদ্বোধন করা হবে। সেখানে স্বৈরাচারের অত্যাচারের চিহ্ন সংরক্ষণ করা হবে।

তিনি বলেন, শুধু স্মৃতিস্তম্ভ নয়, শহীদদের কবর সংরক্ষণের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। আমরা কাজ করছি যাতে ভবিষ্যতে কোনো আধিপত্যবাদী শক্তি আর বাংলাদেশে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।

পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, শহীদরা উদ্দেশ্যহীনভাবে প্রাণ দেননি। তারা প্রাণ দিয়েছেন একটি বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য। তাদের আত্মত্যাগকে সার্থক করতে হলে আমাদের এই বিচার কাজ স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, স্বৈরাচারকে প্রতিহত করে এই দেশের ছাত্র-জনতা একটি নতুন ভোর এনে দিয়েছে। সেই আন্দোলনের পথ ধরে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শহীদদের সম্মান দিতে হলে, শহীদ পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের দীর্ঘ ৩৬ দিনের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে ৩৬ জুলাই তারিখে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধে ফ্যাসিস্ট সরকার পতিত হয়। এই অভ্যুত্থানের সময় নারায়ণগঞ্জে সবচেয়ে ভয়াবহ দমন–পীড়নের ঘটনা ঘটে। পুলিশের গুলিতে নিহত হন অন্তত ৫৬ জন, আহত হন প্রায় ৩৭০ জন। নিহতদের মধ্যে ২১ জন ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা, যাদের স্মরণেই এই স্মৃতিস্তম্ভ।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শহীদ আদিলের মায়ের কান্নায় ভেঙে পড়া মুহূর্ত পুরো পরিবেশকে আবেগাক্রান্ত করে তোলে। 

তিনি বলেন, আমার ছেলে বেঁচে থাকলে আজ এসএসসি পরীক্ষার ফল হাতে নিয়ে আমার কাছে আসত। ফ্যাসিস্টদের গুলিতে সে চলে গেছে। আমি তার হত্যাকারীদের বিচার চাই।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা, পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার, জনপ্রশাসন সচিব মোখলেছুর রহমান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শরফুদ্দিন চৌধুরী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের প্রমুখ।

অনুষ্ঠান শেষে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া ও মোনাজাত করা হয় এবং পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মাধ্যমে দিনের কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘটে।

এই স্মৃতিস্তম্ভ শুধু একটি প্রতীকী স্থাপনা নয়—এটি স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতির স্থায়ী সাক্ষ্য হয়ে থাকবে। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, দেশের প্রতিটি বিভাগ ও জেলা শহরে জুলাই শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হবে, এবং গণঅভ্যুত্থানের রক্তাক্ত ইতিহাস যেন কখনো ভুলে না যাই—সেই দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সমাজ একসঙ্গে বহন করবে।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়