News Bangladesh

নিউজ ডেস্ক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৮:২৫, ১৫ মে ২০২৫

উপদেষ্টা মাহফুজের ওপর বোতল নিক্ষেপ, প্রতিক্রিয়া ও প্রশ্ন 

উপদেষ্টা মাহফুজের ওপর বোতল নিক্ষেপ, প্রতিক্রিয়া ও প্রশ্ন 

ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর কাকরাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর পানির বোতল নিক্ষেপের ঘটনায় সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে তীব্র প্রতিক্রিয়ার ঝড়। ঘটনাটি শুধু একজন উপদেষ্টার ওপর শারীরিক হেনস্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে গণতন্ত্র, আন্দোলনের নৈতিকতা এবং সরকারের দায়বদ্ধতা—এই তিনটি জটিল প্রশ্ন সামনে এনেছে।

বুধবার (১৪ মে) রাত সাড়ে ৯টার দিকে কাকরাইল মসজিদের সামনে আন্দোলনরত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে গেলে মাহফুজ আলমকে লক্ষ্য করে একদল বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগানের মাঝে এক পর্যায়ে তার মাথায় প্লাস্টিকের পানির বোতল ছুঁড়ে মারে। তিনি বক্তব্য অসমাপ্ত রেখেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। 

এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, সমালোচনা গণতান্ত্রিক অধিকার, কিন্তু শারীরিক লাঞ্ছনা বর্বরতা। এই কাজকে কোনোভাবেই ন্যায্যতা দেওয়া যায় না। দোষীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

একই সুরে বক্তব্য দিয়েছেন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। 

তার ভাষায়, উগ্র আচরণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মাহফুজ আলম আপনাদের প্রতিনিধি হিসেবে আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে এমন আচরণ অত্যন্ত দুঃখজনক।

জ্যেষ্ঠ মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের মন্তব্য ছিল আরও ব্যক্তিগত— মাহফুজ আলম আমাদের ভাই। মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু ভাইয়ের সম্মানে আঘাত করা যায় না।

ঘটনার পর মাহফুজ আলম সাংবাদিকদের জানান, একটি ‘চক্র’ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আন্দোলনের মধ্যে প্রবেশ করে ‘স্যাবোটাজ’ করেছে। 

তিনি বলেন, আন্দোলনের দাবিগুলো ন্যায্য হলেও, এর ভেতর থেকে যেভাবে আমার ওপর হামলা হয়েছে, সেটা কোনো শিক্ষার্থীর কাজ হতে পারে না।

এ বক্তব্যে অনেকেই পরোক্ষভাবে ছাত্রদের দায় মুক্ত করে পরিস্থিতির রাজনৈতিক চালচিত্রের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন।

তবে এই ঘটনা সরকারের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতাও উন্মোচন করে। 

হাসনাত আবদুল্লাহ লিখেছেন, ছাত্রদের সামনে উপদেষ্টাদের পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নিজেদের দায় এড়ানোর প্রবণতা দেখিয়েছে। আন্দোলন চলতে থাকলেও বারবার দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। 

আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ইন্টারপোল-বন্দি চুক্তি

এদিকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে লক্ষ্য করে বোতল নিক্ষেপের ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

তিনি বলেন, কয়েক ঘণ্টা আগে মাহফুজ ভাইয়ের সঙ্গে যা ঘটল, তাতে হতাশ হয়েছি। ভাই তো চাইলেই পারতেন, ‘এটা আমার মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়’ বলে এড়িয়ে যেতে।

বুধবার (১৪ মে) রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

পোস্টে তিনি লিখেন, আমাদের নিজস্ব দায়িত্ব আছে সরকারে। মন্ত্রণালয়ের দাপ্তরিক দায়িত্ব ছাড়াও অতিরিক্ত অনেক দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। তারপরও, ছাত্রদের যেকোনো সমস্যা, আন্দোলনের সমাধান কিংবা যৌক্তিক দাবি আদায়ে সবসময় সচেষ্ট থাকার চেষ্টা করি। অন্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়েও মাঝে মাঝে সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন করি এবং সমঝোতার চেষ্টা করি।

তিনি আরও লিখেন, আজকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিষয়টিও আমার অফিসিয়াল দায়িত্বের আওতায় পড়ে না। কিন্তু দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে উদ্যোগ নিয়েছি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন ছিল মূলত তিন দাবিকে ঘিরে—পর্যাপ্ত অবকাঠামো, হল সংকটের সমাধান ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা। কিন্তু আন্দোলনের গতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, যেখানে একপক্ষ সংলাপের মাধ্যমে সমাধান চায়, অন্যপক্ষ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে।

এনসিপির নেতারা একদিকে শিক্ষার্থীদের দাবি বাস্তবায়নের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, অন্যদিকে হামলার ঘটনায় তাদেরও দায়ী করেছেন। এই দ্বৈত অবস্থান থেকেই প্রমাণিত হয়—সমস্যা কেবল সরকারের নয়, আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে।

এখনো পর্যন্ত মাহফুজ আলম আইনি পথে হাঁটবেন কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো ঘোষণা আসেনি। তবে এনসিপির নেতারা আন্দোলনের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ‘ন্যক্কারজনক’ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

এই ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি বাংলাদেশের রাজনীতি ও সামাজিক আন্দোলনের একটি বহুল পরিচিত চিত্র—সংলাপের অভাব, ভুল বোঝাবুঝি, দায়িত্ব এড়ানো এবং প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ। আন্দোলনকারীদের প্রতি সম্মান ও সমর্থন থাকা স্বত্বেও, এই প্রশ্ন অনিবার্য: শারীরিক লাঞ্ছনা কি কোনো গণতান্ত্রিক দাবিকে বৈধতা দিতে পারে?

এই ঘটনায় সরকার, আন্দোলনকারী, এবং জনগণ—তিন পক্ষেরই আত্মসমালোচনা জরুরি। অন্যথায়, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আরও তলানিতে পৌঁছাবে। এখন সময় এসেছে—শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিবাদ, এবং দায়িত্বের সঙ্গে নেতৃত্বের নতুন ব্যাখ্যা তৈরি করার।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়