৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া
ফাইল ছবি
দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, উচ্চ খেলাপি ঋণ এবং তীব্র মূলধন ঘাটতির কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৯টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) বন্ধ (অবসায়ন) করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের অনুমোদন নিয়ে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য হলো ক্ষুদ্র আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, যে ৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, আভিভা ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
এই প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থা এতটাই নাজুক যে, এদের বেশিরভাগের খেলাপি ঋণ মোট ঋণের প্রায় ৮০ থেকে ৯৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এই ৯টি প্রতিষ্ঠান আমানতকারীর দায় পরিশোধে ব্যর্থ, উচ্চ খেলাপি ঋণের বোঝা বহন করছে এবং ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
- এফএএস ফাইন্যান্স: মোট ঋণের ৯৯.৯৩ শতাংশ খেলাপি।
- ফারইস্ট ফাইন্যান্স: ৯৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি।
- বিআইএফসি: ৯৭.৩০ শতাংশ ঋণ খেলাপি।
- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং: ৯৬ শতাংশ ঋণ খেলাপি (পরিমাণ প্রায় ৩,৯৭৫ কোটি টাকা)।
- পিপলস লিজিং: ৯৫ শতাংশ ঋণ খেলাপি।
- আভিভা ফাইন্যান্স: ৮৩ শতাংশ ঋণ খেলাপি।
- প্রাইম ফাইন্যান্স: ৭৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি।
- প্রিমিয়ার লিজিং: ৭৫ শতাংশ ঋণ খেলাপি।
- জিএসপি ফাইন্যান্স: ৫৯ শতাংশ ঋণ খেলাপি।
এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণও হাজার হাজার কোটি টাকা, যা এদের কার্যক্রম পরিচালনাকে সম্পূর্ণ অচল করে দিয়েছে। এই ৯টি প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট এনবিএফআই খাতের খেলাপি ঋণের ৫২ শতাংশ।
আরও পড়ুন: ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের ভাবনা
বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন, ২০২৩’ এর ৭(১) ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স বাতিলের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবসায়ন করবে। এই আইন আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম এবং দায় পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে লাইন্যেস বাতিলের সুযোগ দেয়। গত ২২ মে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাদের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রেজল্যুশন ডিপার্টমেন্ট এরই মধ্যে গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সম্মতি নিয়ে অবসায়নের প্রস্তুতি নিতে কাজ শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হাইকোর্টে আবেদন করে আদালতের মাধ্যমে অবসায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে এবং এজন্য একজন বা একাধিক লিকুইডেটর (প্রতিষ্ঠান বন্ধের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি/সংস্থা) নিয়োগ করা হবে।
প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, এই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধে সরকারের প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়াই হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
দেশের মোট ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত ৪৮ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সমস্যাগ্রস্ত ২০টি প্রতিষ্ঠানের আমানত ২২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এই সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ব্যক্তি আমানত প্রায় ৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, অবসায়ন প্রক্রিয়ায় সবার আগে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।
পাশাপাশি, এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত কর্মচারীরা চাকরিবিধি অনুযায়ী তাদের প্রাপ্য সকল সুযোগ-সুবিধা পাবেন।
বর্তমানে দেশের ৩৫টি এনবিএফআই এর মধ্যে ২০টি প্রতিষ্ঠানকে ‘সমস্যাগ্রস্ত’ বা ‘রেড ক্যাটাগরি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ২০টি প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণের পরিমাণ ২৫,৮০৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২১,৪৬২ কোটি টাকাই খেলাপি (৮৩.১৬%)। বিপরীতে, এই ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পদের মূল্য মাত্র ৬,৮৯৯ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকা ১৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার মাত্র ৭.৩১ শতাংশ। গত বছর তারা ১,৪৬৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছে এবং তাদের মূলধন উদ্বৃত্ত রয়েছে ৬,১৮৯ কোটি টাকা।
এই সিদ্ধান্তকে দেশের অর্থনীতিবিদরা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। এটি একদিকে যেমন আর্থিক খাতে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অনিয়মের অবসান ঘটাবে, তেমনি ভবিষ্যতে আরও অনেক দুর্বল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পথ খুলে দেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, এই ৯টি ছাড়াও প্রয়োজনে আরও সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের আওতায় আনা হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই পদক্ষেপ জনআস্থাকে সাময়িকভাবে প্রভাবিত করতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার জন্য অপরিহার্য। এটি কেবল সংকটাপন্ন প্রতিষ্ঠানের পতন নয়, বরং একটি স্বাস্থ্যকর ও শক্তিশালী আর্থিক খাতের সূচনা হতে পারে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








