আবু তাহের সরফরাজের কিস্সা
জনাব, আপনার পরিচয় কি
দরজা নদীর তীরে এসে দাঁড়ালেন হাসান বসরি। শেষবিকেলের ছায়া ছায়া নরম রোদ নদীর তীরে। ঝিরঝির হাওয়া দিচ্ছে। মনটন বেশ ভালো হয়ে যায় এরকম হাওয়ায়। কী রকম ফুরফুরে লাগে। হাসানেরও লাগল।
ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় তিনি দেখলেন, তীরে ঘাসের ওপর একলোক এক নারীর সঙ্গে বসে আছে। কীসব যেন লোকটি বলছে। তার সামনে পানপাত্র, হাতে গেলাশ। কথা বলতে বলতে সে পাত্র থেকে গেলাশে তরল ঢেলে তা পান করছে।
চোখ সরিয়ে নিলেন হাসান বসরি। ভাবলেন, আমি লোকটির মতো চটুল নই। আল্লাহর শুকরিয়া।
বাঁচাও... বাঁচাও...
অনেক মানুষের মিলিত আর্তনাদ শুনতে পেলেন হাসান। মুহূর্তের ঝলকমাত্র। তিনি দেখলেন, দজলায় তুফান উঠেছে। এক নৌকা থেকে আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য হতচকিত হয়ে গেলেন তিনি। ঠিক সেমুহূর্তে দজলায় ওই লোকটিকে ঝাপিয়ে পড়তে দেখলেন তিনি। তার পেছনে হাসানও ঝাপিয়ে পড়লেন। তারা লোকগুলোকে তীরে তুলে আনলেন।
কিছু সময় পর লোকটি বলল, এই যে নারীকে দেখছেন, সে আমার মেয়ে। আমার সামনে যে পানপাত্র তাতে পবিত্র পানীয়। আপনি চোখে দেখতে পান, কী পান না, তা দেখাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।
হাসান জিগেশ করলেন, কি দেখলেন?
লোকটি বলল, আপনি অন্ধ। তাই ভাবছিলেন আমার চেয়ে আপনি মহৎ। দজলায় যখন তুফান ওঠে আপনার আত্মগরিমা তখনও কাটেনি। তাই দজলায় আমার দেখাদেখি আপনি ঝাপ দিলেন লোকগুলোকে উদ্ধার করার জন্য।
লজ্জায় কাঁপতে লাগলেন হাসান বসরি। বিনীত স্বরে তিনি জিগেশ করলেন, জনাব, আপনার পরিচয় কি?
লোকটিও তাকে জিগেশ করল, আপনার পরিচয় কি?
দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইল। কেউ-ই জবাব দিতে পারলেন না।
সামান্য উপহার
হাসান বসরি শুনলেন, একলোক জনসমাজে তার খুব নিন্দেমন্দ করে। একঝুড়ি ভালো মানের খেজুর মাথায় নিয়ে হাসান একদিন গেলেন ওই লোকের বাড়ি। লোকটির সামনে ঝুড়ি নামিয়ে বিনীতভাবে বললেন, জনাব, জানতে পারলাম আপনি নাকি আপনার আমলনামার সওয়াবগুলো আমার আমলনামায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এর বিনিময়ে আমার উচিত আপনাকে দামি কিছু উপহার দেয়া। কিন্তু আমার পক্ষে সামান্য এই একঝুড়ি খেজুর আনা সম্ভব হয়েছে। দয়া করে এখন এগুলো গ্রহণ করুন।
আলো কোথায় চলে গেল
জ্বলন্ত প্রদীপ হাতে এক বালক যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। একই রাস্তা দিয়ে আসছিলেন হাসান বসরি। মুখোমুখি দেখা হলে বালককে তিনি জিগেশ করলেন, বাছা, এ আলো তুমি কোত্থেকে নিয়ে এলে?
বালক দাঁড়িয়ে পড়ল। ফুঁ দিয়ে প্রদীপটি নিভিয়ে দিয়ে সে জিগেশ করল, আগে আপনি বলুন, আলো এখন কোথায় চলে গেল?
আপনার দেখছি সবদিক ঠিক আছে
রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন হাসান বসরি। দেখলেন, আলুথালু বেশে এক নারী হেঁটে যাচ্ছে। হাসান তাকে ডেকে বললেন, মাগো, নিজের লজ্জাস্থানগুলোর বিষয়ে একটু সচেতন থাকুন।
নারীটি জবাবে তাকে বলল, আমার স্বামীর মৃত্যুশোকে কিছু সময়ের জন্য আমি অসচেতন হয়ে পড়েছি। কিন্তু আমি অবাক হলাম আপনার কথা ভেবে। শুনেছি আপনি দরবেশ। সদা-সর্বদা আল্লাহর প্রতি মগ্ন। কিন্তু এখন দেখছি আপনার সবদিক ঠিক আছে।
দরবেশ কুপোকাত হলে শিষ্যদের কী হবে
এক মাতাল হেলেদুলে গানটান গাইতে গাইতে যাচ্ছে। ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন হাসান বসরি। কিছু সময় আগে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় রাস্তা কিছুটা পিচ্ছিল। তাই মাতালকে তিনি বললেন, পথ পিচ্ছিল। সাবধানে পা ফেলুন। নয়তো আছাড় খেতে পারেন।
তার কথা শুনে মাতাল খিকখিক হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, আপনি নিজে সাবধান হন। আমি তো মাতাল, আছাড় খেলে আমার তেমন কিছু হবে না। গায়ে-জামায় একটু কাদা লাগবে, এই যা। কিন্তু আপনি তো দরবেশ। আছাড় খেলে আপনার কাপড়-চোপড় নোংরা হয়ে যাবে। আপনার কত কত শিষ্য-সাগরেদ। তারা সবাই আপনার ওপর নির্ভর করে চলে। আপনিই যদি কুপোকাত হয়ে যান, তবে তাদের অবস্থা কী হবে!
লজ্জায় লাল হয়ে উঠল হাসান বসরির মুখ। কোনো কথাই তিনি আর বলতে পারলেন না।
আল্লাহকে দেখা
নদীর তীরে শিষ্যদের সাথে বসে আছেন ইমাম জাফর সাদেক। এমন সময় এক লাক এলো তার কাছে। সালাম জানিয়ে বলল, জনাব, আমি আল্লাহকে দেখতে চাই।
জাফর সাদেক তাকে বললেন, মূসাকে আল্লাহ বলেছিলেন, ‘তুমি কিছুতেই আমাকে দেখতে পাবে না।’ সেখানে তুমি কীভাবে আল্লাহকে দেখতে পাবে?
লোকটি বলল, জনাব, সেটা তো মূসার ব্যাপার। মূসার সময় শেষ, এখন শেষনবির জামানা। আমি শুনেছি, কোনও এক দরবেশ বলেছেন, ‘আমার হৃদয় সৃষ্টিকর্তাকে দেখেছে।’ আরেক দরবেশ বলেছেন, ‘সৃষ্টিকর্তাকে না দেখে তার উপাসনা আমি করব না।’
জাফর সাদেক এবার শিষ্যদের বললেন, লোকটির হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দাও।
শিষ্যেরা এগিয়ে এলো। ধস্তাধস্তি করেও লোকটি নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। হাত-পা বেঁধে তাকে ফেলে দেয়া হলো নদীতে। পানিতে পড়তে পড়তে সে চিৎকার করে উঠল, আমাকে বাঁচাও... বাঁচাও...
কিন্তু কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে এলো না। ডুবতে ডুবতে লোকটি প্রাণপণে মনে মনে বলল, আল্লাহ আমাকে বাঁচাও।
ঠিক সেই মুহূর্তে জাফর সাদেকের নির্দেশে দুই শিষ্য তাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো। লোকটি একটু সুস্থ হলে জাফর সাদেক তাকে বললেন, আল্লাহকে দেখতে পেয়েছো?
লোকটি বলল, যতক্ষণ আমার চোখের সামনে পর্দা ছিল ততক্ষণ আমি মানুষের কাছে সাহায্য চেয়েছি। কিন্তু মৃত্যুমুহূর্তে আমার চোখের পর্দা উঠে গেল। আমি অনুভব করলাম পরম সেই সত্ত্বাকে। আর তার কাছেই বাঁচার আকুতি জানালাম।
জাফর সাদেক বললেন, হ্যাঁ, এরপর আমার নির্দেশ পেয়ে দুজন তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো।
লোকটি জিগেশ করল, আমি যে ঠিক ওই মুহূর্তেই আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায়, এটি কীভাবে টের পেলেন আপনি?
জাফর সাদেক বললেন, ওই মুহূর্তেই আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দেন তোমাকে উদ্ধার করার জন্য।
লোকটি জিগেশ করল, কীভাবে নির্দেশ দিলেন?
জাফর সাদেক বললেন, ইঙ্গিতে। তার ইঙ্গিতের ভাষা বুঝতে পারলেই তাকে চেনা যায়। দেখা যায়। যে রকম মৃত্যুমুহূর্তে তুমি তাকে দেখতে পেয়েছিলে।
অহংকার নয়, সৃষ্টির আত্মপ্রকাশ
এক লোক জাফর সাদেককে বললেন, আপনার মধ্যে জাহেরি-বাতেনি শক্তি থাকার পরও অনেক সময় দেখেছি, নিজেকে আপনি একটু বড় ভাবেন।
লোকটির কথা শুনে হাসলেন জাফর সাদেক। বললেন, দেখুন, আমার যা অহংকার তার সবই তো ধুয়েমুছে ফেলেছি। তবে আল্লাহর দেয়া কিছু গৌরব থাকে যা নিজের থেকেই প্রকাশিত হয়। সেখানে মানুষের করার কিছুই নেই। তাই তা অহংকার নয়, সৃষ্টির আত্মপ্রকাশ।
আপনিও তো একজন মানুষ
দামি পোশাক পরে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন ইমাম জাফর সাদেক। পথে এক লোক সালাম জানিয়ে তাকে বলল, জনাব, কিছু মনে করবেন না, নবিবংশের কোনো ব্যক্তির জন্য দামি পোশাক পরা ঠিক নয়।
জাফর সাদেক লোকটির এক হাত নিজের জামার ভেতর ঢুকিয়ে বললেন, দেখুন, ভেতরের জামাটা খসখসে মোটা। বাইরের জামাটা পরি যখন আমি মানুষের সামনে চলাফেরা করি। আর ভেতরের জামাটা পরি যখন আমি নামাজে আল্লাহর সামনে দাঁড়াই।
একথা শুনে লোকটি লজ্জা পেল। জাফর সাদেক তার লজ্জিত মুখের দিকে চেয়ে বললেন, মানুষ দ্যাখে বাইরেরটা, আর আল্লাহ দেখেন ভেতরেরটা। আপনি লজ্জিত হবেন না জনাব। আপনিও তো একজন মানুষ।
মানুষ যে
বড়পির আব্দুল কাদের জিলানি তখন যুবক। পথ চলতে চলতে একদিন হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। সৌন্দর্যের বিস্ময়কর ছটায় তিনি হতচকিত। শিরশির কাঁপুনি টের পেলেন রক্তের কোষে কোষে।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবতী। মুচকি হাসি তার ঠোঁটে। হাসি ছড়ানো এই ঠোঁটের জীবন্তদৃশ্য হৃদয় চিরে দেয়ার মতো। বড়পির তাই মাথা নিচু করে রাস্তা পেরিয়ে গেলেন। মসজিদে এসে তিনি দেখলেন, পথে দেখা যুবতীটি মসজিদের আবর্জনা পরিষ্কার করছে। দ্বিতীয়বার আর তার দিকে তাকালেন না বড়পির।
নামাজ শেষ করে তার আবাসস্থল মাদ্রাসাকক্ষে এলেন। দেখলেন, যুবতী মাদ্রাসার বারান্দা ঝাঁট দিচ্ছে। বড়পির জিগেশ করলেন, হে সুন্দরের রানি, তুমি কে?
যুবতী বলল, মায়াবিনী।
বড়পির বললেন, মায়াবিনী তো বটেই। সুন্দরের আরেক নামই যে মায়া। কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি তোমার সত্যিকারের পরিচয়। বারবার এভাবে আমাকে প্রলুব্ধ করছ কেন?
মায়াবিনী বলল, আমি পৃথিবী। পৃথিবীর মায়াময় সৌন্দর্যে আপনাকে মুগ্ধ করতে চেষ্টা করছি।
বড়পির বললেন, তোমার চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কেননা, মুগ্ধতার পথ আমি পেরিয়ে এসেছি। বেহেস্ত থেকে বিতাড়িত হওয়ার সময় ইবলিস আল্লাহকে বলেছিল, ‘আদম সন্তানকে আমি পৃথিবীর সৌন্দর্যের দিকে আকৃষ্ট করে বিপদগামী করব।
থামলেন বড়পির। বললেন, সৌন্দর্য তবে কি পাপ? না হে, তা নয়। জগৎ-সংসারে মানুষ বেঁচেই থাকে কোনো না কোনো সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে। এ মুগ্ধতা না থাকলে মানুষের অনুভূতির জগৎ ও চেতনা শূন্য হয়ে যায়। শূন্য এই অবস্থানে যে মানুষ চলে যায় সে পরম সত্ত্বার সাথে লীন হয়ে যায়। কেননা, ততদিনে সে জেনে যায়, জগতের প্রতিটি বস্তুই সুন্দর। আর প্রতিটি সুন্দরই এক একটি মায়ার খেলা। এ খেলায় জয়-পরাজয় আছে। যন্ত্রণা আছে। আবার আনন্দের শিহরণও আছে। তবে শেষমেষ যা পাওয়া যায় তা ব্যর্থতার অবসাদ। সারা দেহে ফুটে থাকে ব্যর্থতার ক্ষত-বিক্ষত চিহ্ন। এই যন্ত্রণা মানুষকে কয়েক টুকরো করে ভেঙে ফ্যালে। আমি মুগ্ধ আছি আমার অন্তর্জগতের সৌন্দর্যে। আর তাই আমি সুখি।
মায়াবিনী চুপচাপ শুনছিল বড়পিরের কথা। এবার জিগেশ করল, অন্তর্জগতেই যদি মুগ্ধ থাকবে তবে বারবার আমাকে দেখে শিহরিত কেন হলে?
বড়পির জবাব দিলেন, মানুষ যে! তবে আমি ভোগ করি না। উপভোগ করি। ভোগের আনন্দ ভোগের মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়। আর উপভোগের আনন্দ থাকে আমৃত্যু।
মানুষের চরিত্র আগে থেকেই লিখিত
আখরোট কিনতে গেছেন আবুল আব্বাস সাইয়ারি। দোকানি তাকে দেখেই কর্মচারীকে বলল, হুজুরকে বেছে বেছে ভালো আখরোট দাও। এরপর সাইয়ারিকে জিগেশ করল, ক’টা নেবেন হুজুর?
সাইয়ারি বললেন, সব খদ্দেরকেই কি আপনি বেছে বেছে ভালোগুলো দেন?
দোকানি বলল, না হুজুর। আপনি ভালো মানুষ, তাই আপনাকেই দিচ্ছি।
সাইয়ারি বললেন, আমি আমার ভালো মানুষকে আখরোটের বিনিময়ে বেচতে রাজি নই। কেননা এখন আমি তা বেচলে আখেরাতে কি দিয়ে বেহেস্ত কিনব? যে ক’টা আখরোট আমি নিতে চেয়েছিলাম, এই নাও তার পয়সা।
এই বলে তিনি চলে এলেন। কিছু দূর আসার পর পেছনফিরে দেখলেন, এক লোক তার পিছু পিছু হেঁটে আসছে। তিনি দাঁড়ালেন। লোকটি এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম জানালো। সালামের জবাব দিলেন সাইয়ারি।
লোকটি বললেন, আমি এই প্রদেশের শাসনকর্তা। আপনি আমাকে চেনেন না, কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। আর আখরোটের দোকানে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমার সামনেই ঘটে। যদিও আপনি আমাকে দেখেননি, কিন্তু আমি সেখানে ছিলাম।
সাইয়ারি বললেন, আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান?
শাসনকর্তা বললেন, জি।
সাইয়ারি বললেন, তবে বলুন।
শাসনকর্তা বললেন, জ্ঞান কি?
সাইয়ারি জবাব দিলেন, দেখে-শুনে-পড়ে জগৎ-সংসার বিষয়ে যে ধারণা মানুষ অর্জন করে, তা-ই জ্ঞান।
শাসনকর্তা এবার জিগেশ করলেন, পরম জ্ঞান কি?
সাইয়ারি জবাব দিলেন, জ্ঞানের স্তূপ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নির্ভার হবার যে আনন্দ, তাই পরম জ্ঞান।
একটু সময় চুপ থেকে শাসনকর্তা বললেন, জগতে আপনি কি আশা করেন?
সাইয়ারি জবাব দিলেন, যে আশা আল্লাহ আগে থেকেই পূরণ করে রেখেছেন, তা-ই।
এবারও কিছু সময় চুপ করে থেকে শাসনকর্তা বললেন, আপনি কি নিশ্চিত, জগৎ-সংসারে প্রতিটি মানুষের চিত্রনাট্য আগে থেকেই লিখিত?
সাইয়ারি জবাব দিলেন, লাওহে মাহফুজে আমাদের যার যে চরিত্র লেখা রয়েছে, তার থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই। অথচ প্রতিটি মানুষ তার লিখিত চরিত্র থেকে মুক্তি পেতে চায়।
থামলেন সাইয়ারি। দেখলেন, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন শাসনকর্তা। বোঝাই যাচ্ছে, তার মনোযোগ দক্ষ তীরন্দাজের মতো অব্যর্থ।
শাসনকর্তার এই মনোযোগে খুশি হলেন সাইয়ারি। জ্ঞান এখনও তার পাত্র পূর্ণ করতে পারেনি। পাত্র পূর্ণ হয়ে গেলে কেউ আর জ্ঞানের কথায় মনোযোগ দেয় না।
সাইয়ারি এবার বললেন, কোরআনের আয়াত ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে যদি নামাজ পড়া হতো, তবে তা এই কবিতা। এরপর সাইয়ারি আবৃত্তি করলেন,
জীবনে বেঁচে আছি, একটাই আশা
মুক্ত কোনো মানুষকে যদি দেখতে পাই!
মনের খুঁতখুঁত
কয়েকদিন ধরে মনের খুঁতখুঁতে ভুগছেন আবু আলি মো. রোদবারি। ওজু করছেন, উঠে এসেই আবার মন খুঁতখুঁত করছে। ওজু বোধহয় ঠিকঠাক হয়নি। ফিরে এসে আবার ওজু করছেন।
গোধূলির রঙ ছড়িয়ে সূর্য ডুবতে বসেছে। মাগরিবের সময়। ওজু করলেন রোদবারি। উঠে কয়েক পা বাড়িয়েই মনের খুঁতখুঁত। ফিরে আবার ওজু করলেন। এভাবে এগারোবার তিনি ওজু করলেন। তারপর দেখলেন, পৃথিবীতে সন্ধে নেমে এসেছে। মাগরিবের সময় শেষ।
ভীষণ রকম বিচলিত হয়ে পড়লেন রোদবারি। নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। কাঁদতে লাগলেন তিনি। বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ, আমার মনের খুঁতখুঁত তুমি দূর করে দাও। এই খুঁতখুঁতই আমাকে সরিয়ে দিচ্ছে তোমার ইবাদত থেকে।
একসময় থামলেন রোদবারি। ডুবে গেলেন গভীর নীরবতায়। আর তখন শুনতে পেলেন অলৌকিক স্বর: মনের খুঁতখুঁত তোমার অজ্ঞতা। তুমি জ্ঞান লাভ করো। জ্ঞানেই স্থিরতা পাবে।
রোদবারি বললেন, জ্ঞান মানেই তো নানা মুনির নানা মত। নানা পথ। প্রতিটি জ্ঞানই তাই এক একটি বিভ্রান্তি।
অলৌকিক স্বর বললেন, তা ঠিক। আমি যে জ্ঞানের কথা বলেছি তা আত্মজ্ঞান। নানা মুনির নানা পথ ঘুরে এসে নিজের মতে স্থির হওয়াকেই বলে আত্মজ্ঞান।
বাতাসের মর্মর ধ্বনির মানে
কুয়োর পাশে কয়েকজন শিষ্যের সঙ্গে বসে আছেন দরবেশ আবু ওসমান সাঈদ। এক লোক চড়কার সাহায্যে কুয়ো থেকে পানি তুলছিল। আর চড়কার শব্দ হচ্ছিল, ঘরঘর... ঘরঘর...
সাঈদ শিষ্যদের বললেন, চড়কার শব্দ কি বলছে, জানো কেউ?
শিষ্যেরা বলল, না। আপনিই বলে দিন।
সাঈদ বললেন, পাখির ডাক ও বাতাসের মর্মর ধ্বনির মানে যে মানুষ জানে, সে মানুষই আল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে পারে।
গোপনকথা
নামাজ পড়ছিলেন দরবেশ আবুল হাসান খেরকানি। আত্মার ভেতর থেকে তিনি শুনতে পেলেন পরমাত্মার স্বর: জগতের গোপন সূত্রগুলো তুমি যে জানো তা যদি আমি মানুষকে জানিয়ে দেই, তবে তোমাকে তারা পাথর মেরে মেরে হত্যা করবে। এবার বলো, তুমি কি তাতে রাজি আছো?
আবুল হাসান বললেন, আপনার করুণার যে পরিচয় আমি জানি তা যদি মানুষদের বলে দেই, তবে তারা আর আপনাকে সেজদা করবে না। আমি কি তাদেরকে আপনার গোপনকথা বলব?
পরমাত্মা বললেন, না, থাক। তবে আমিও কিছু বলব না, তুমিও কিছু বলবে না।
জগতের সব নারী তা করতো
দরবেশ আবুল হাসান খেরকানিকে একলোক বলল, জনাব, আপনার গায়ের জামাটি যদি আমাকে দান করেন তবে আমি ধন্য হয়ে যেতাম।
দরবেশ বললেন, কীভাবে ধন্য হতেন?
লোকটি বলল, বরকতময় এ জামা গায়ে দিলে আমি আল্লাহর নৈকট্য পেয়ে যেতাম।
দরবেশ হাসলেন। বললেন, কোনও নারী পুরুষের পোশাক পরে যদি পুরুষ হতে পারত তবে জগতের সব নারীই তা করতো। আর নারীদের পোশাক পরে যদি নারী হওয়া যেত তবে জগতের সব পুরুষই তা করতো।
দরবেশের কথা শুনে লোকটি মাথা নত করে রইল। তবে তা লজ্জায় নয়, নতুন একটি বোধ উপলব্ধির আনন্দে।
খান্নাস
আদম ও বিবি হাওয়া ইবলিসের ধোঁকায় পড়ে গন্ধম খেলেন। এরপর তারা ভুল বুঝতে পেরে আল্লাহর কাছে মাফ চাইলেন। আল্লাহ তাদেরকে মাফ করলেন। আর তাই, আদম-হাওয়া আবারও একসঙ্গে থাকতে শুরু করলেন।
একদিন বিবি হাওয়া একা ছিলেন। ইবলিস এলো তার কাছে, সঙ্গে এক ছোট্ট শিশু।
ইবলিস বলল, এটি আমার ছেলে খান্নাস। বিশেষ দরকারে আমাকে দূরে যেতে হচ্ছে। তোমার আপত্তি না থাকলে কিছু সময় খান্নাসকে তোমার কাছে রেখে যেতে চাই।
বিবি হাওয়া আর আপত্তি করলেন না। বললেন, থাক, ছোট্ট শিশু! কিন্তু তুমি যেন আবার বেশি দেরি করো না। ওদিকে উনি এসে পড়বেন।
ইবলিস চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আদম ফিরে এলেন। প্রিয়তমা হাওয়া তখন খান্নাসের সঙ্গে গল্পগুজবে মেতে উঠেছে। বিবির ওপর বেশ চটলেন আদম। বললেন, খান্নাস যে ইবলিসের সন্তান তা তো তুমি জানো। তবু তার সঙ্গে তুমি, ছিঃ! আমি অবাক হচ্ছি, কীভাবে তুমি ইবলিসের ধোঁকার কথা এরই মধ্যে ভুলে গেলে?
এই বলে আদম খান্নাসের দেহ কয়েক টুকরো করে ঝুলিয়ে রাখলেন বিভিন্ন গাছের ডালে।
আরেকদিন। বিবি হাওয়া একা বসে আছেন। ইবলিস এলো। জিগেশ করল, খান্নাস কোথায়?
হাওয়া সব কথা তাকে বললেন।
একথা শুনেই ইবলিস চিৎকার দিয়ে উঠলেন, খান্নাস?
সাথে সাথে খান্নাসের খণ্ডিত দেহ এক হয়ে গেল। জীবিত হয়ে উঠল খান্নাস।
বিবি হাওয়াকে ইবলিস বলল, দ্যাখো, আমার কাজ এখনো শেষ হয়নি। অথচ এই শিশু-বাচ্চাটাকে নিয়ে পড়েছি বিপাকে। তুমি কি কিছু সময়ের জন্য একে তোমার কাছে রাখবে?
হাওয়া বলে উঠলেন, না-না, তা আর সম্ভব না। আদমের কড়া নিষেধ। খান্নাসকে আমি আর আমার কাছে রাখতে পারব না।
ইবলিস তবু নাছোড়বান্দা। শেষমেষ রাজি হলেন বিবি হাওয়া। তবে শর্ত দিলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে ইবলিস ফিরে আসবে।
ইবলিস কিন্তু ফিরল না। ফিরলেন আদম। এবার আদম বললেন, দ্যাখো বিবি, বারবার তুমি সীমালঙ্ঘন করছ, কেন করছ?
বিবি হাওয়া নিরুত্তর। মাথা তার নত।
এবার আগুনের কুণ্ডলির মধ্যে ফেলে খান্নাসকে ভস্ম করলেন আদম। অর্ধেক ছাই উড়িয়ে দিলেন বাতাসে, বাকিটা ভাসিয়ে দিলেন সমুদ্রের পানিতে।
আরো একদিন। গাছের নিচে একা একা বসে আছেন বিবি হাওয়া। ইবলিস এলো। তাকে দেখেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন বিবি হাওয়া। বললেন, তুমি তো আসলেই মহাবদ। সেই যে ছেলেকে রেখে গেলে, আর এই এলে?
ইবলিস বিনীতভাবে বলল, কী করব, আমার কী আর একটা-দুটো কাজ। তা খান্নাস কোথায়?
বিবি হাওয়া বললেন, সে নেই। আদম তাকে পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলেছে।
একথা শুনেই ইবলিস চিৎকার দিয়ে উঠল, খান্নাস?
মুহূর্তে বাতাসে উড়ে যাওয়া আর সমুদ্রে মিশে যাওয়া ছাই এক হয়ে খান্নাস জীবিত হয়ে উঠল।
বিবি হাওয়াকে ইবলিস বললেন, তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই। অনেক করেছ তুমি, তবে এবার যদি...
হাওয়া বলে উঠলেন, না-না। তোমার খান্নাসকে এবার তুমি নিয়ে যাও। অনেক হয়েছে, আর আমি তাকে রাখতে পারব না।
ইবলিস খুব বিনীতভাবে বলল, তুমি তো মমতাময়ী মায়ের জাতি। এরকম নিষ্ঠুরতা কি তোমাকে মানায়? আমি কথা দিচ্ছি, আমি যাব আর আসব। দু’পলক মাত্র সময়। এ মুহূর্তটুকু কি তুমি খান্নাসকে তোমার কাছে রাখতে পারবে না?
হাওয়া বললেন, ঠিক আসবে তো?
ইবলিস বলল, ঠিক আসব।
কিন্তু ইবলিস এলো না। কিছু সময় পর আদম ফিরে অবস্থা দেখে হাওয়াকে কিছুই বললেন না। তবে খান্নাসকে জবেহ করলেন। মাংস ছোট ছোট টুকরো করে রান্না করলেন। রান্না মাংস অর্ধেক খাওয়ালেন বিবি হাওয়াকে, বাকিটা তিনি খেলেন।
দূরে দাঁড়িয়ে ইবলিস সবই দেখল। পুত্রশোক কিছুটা পেলেও সে চূড়ান্ত খুশি হলো। কেননা, সে যা চেয়েছিল তাই হয়েছে। তার সন্তান খান্নাস এখন মিশে গেছে আদম আর হাওয়ার রক্তে।
(খান্নাসিল্লাযি ইউওয়াসবিসু ফি সুদুরিন্নাস, মানে, খান্নাস মানুষের মনের গভীরে প্ররোচনা দেয়। কোরআনের এ আয়াতের ব্যাখা হিসেবে দরবেশ আলি হাকিম তিরমিজি খান্নাসের এ কেচ্ছা শিষ্যদের বলেন।)
সূত্র: তাজকেরাতুল আউলিয়া
আবু তাহের সরফরাজের চিত্রনাট্য: লাল জুতো শাদা মোজা
নিউজবাংলাদেশ.কম/এসজে
নিউজবাংলাদেশ.কম








