News Bangladesh

|| নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৭ আগস্ট ২০১৫
আপডেট: ১৭:১৬, ৫ নভেম্বর ২০২০

তাহমিনা হাকিম অনুদিত

মনিকা ডিকেন্সের আত্মজীবনী: এক জোড়া পা

মনিকা ডিকেন্সের আত্মজীবনী: এক জোড়া পা

 

চতুর্থ অধ্যায়

একমাত্র হারেম ছাড়া মেয়েদের কোথাও একত্রে ছেড়ে দিলে সে এক বিশৃঙ্খলা হয়ে উঠবে। তাঁরা নিজেদের কাজের গুরুত্ব বোঝাতে তাকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে এমন বড় করে তুলবে যে তা এক সময় পুরো পৃথিবীকেই গ্রাস করে ফেলতে চাইবে। পুরুষেরা সাধারণত এমনটি নয়। তাঁরা তাঁদের কাজ, গার্হস্থ্য জীবন, রোমান্স, রিলাক্সেশন ইত্যাদি কবুতরের খোপের মত আলাদা আলাদা খোপে ভরে রাখতে জানে। কিন্তু মেয়েরা সাধারণত এমনটি পারে না। তাঁরা এমনটি করতে গিয়ে যেকোন একটি খোপ এতোটাই ভরিয়ে তোলে যে এক খোপের জিনিস তখন উপচিয়ে অন্য খোপে ঢুকে যায়। জানি না শুধু রেডউডের নার্সেরাই এতো টিপিকাল কি না? তবে তাঁদের অধিকাংশেরই এই হাসপাতালের কয়েকশগজ বাইরের জীবন নিয়ে আর কোন আগ্রহ নেই। “নার্সিং টাইমস” ছাড়া আর কোন পত্রিকা তাঁরা পড়ে না। আর কমনরুমে ঠিক তখনই গিয়ে জড়ো হয় যখন রাত নয়টার সংবাদ সমাপ্ত হয়। তাঁরা যুদ্ধ নিয়ে ঠিক ততটুকুই আগ্রহ প্রকাশ করে যুদ্ধ ঠিক যতটুকু তাঁদের চায়ের জ্যাম নয়তো ডেটল আর তুলার ঘাটতিতে প্রকাশ পায়।

হাসপাতালের বেডগুলির সাথে এয়ারফোন সংযুক্ত থাকে। আর একটা সেন্ট্রাল রিসিভিং সেট থেকে বেডগুলিতে সম্প্রচার অব্যাহত থাকে। আমি সকালে লকার পরিষ্কার করার সময় সাধারণত রোগীদের কাছে সাতটার খবরের বৃত্তান্ত শুনতে চাই। একদিন এক রোগী আমাকে জিজ্ঞেস করে সাতটার খবর নিয়ে আমার এতো আগ্রহের কারণ কি? আমি তাঁকে বলি, “জানি না। আমি মনে হয় দেশ বিদেশের হালচাল জানতে উৎসুক।” সে আমাকে বলে আমি অন্য নার্সদের মত নই। অন্য নার্সেরা তাঁদের কাজের বাইরে আগ্রহ খুব কমই প্রকাশ করে। এটাই হল বাইরের পৃথিবীর ধারণা সমগ্র নার্সকূল নিয়ে।

নার্স ডোনাভান একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করে, “গতকাল রাতে সিস্টার ম্যাসনের সাথে তোমার কি নিয়ে কথা হচ্ছিল?”

 আমি বলি, “যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতি কোনদিকে মোড় নেবে এইসব আরকি।”

সে বলে, “গুড গ্রেসিয়াস! তোমরা কি কথা বলার আর কিছু খুঁজে পাও না?”

আমি তাঁকে বলি, “ধর, কোন জার্মান অফিসার অতর্কিতে এসে এই ওয়ার্ডের দখল নিয়েছে, তখন তুমি কি বিষয়ে আলোচনা করবে? ”

সে অট্টহাসি হেসে উত্তর দেয়, “সম্ভবত আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করব সকালে তাঁর বাওয়েল পরিস্কার হয়েছে কি না!?! ”

কেউ কেউ ভীষণ বিতৃষ্ণা মনে নিয়ে এই কাজটি করে। যেমন, ইউনিফর্মে বিতৃষ্ণা, রোগীদের প্রতি বিতৃষ্ণা, সিস্টারদের প্রতি বিতৃষ্ণা মোটকথা সব কিছুর প্রতিই এক ভয়াবহ বিতৃষ্ণা তারা লালন করে চলে। যদি তাঁদের জিজ্ঞেস করা হয় নিজের কাজটিকে তো অন্তত অতোটা ঘৃণা তাঁরা করে না?! তাঁরা উত্তর দেয়, “এই চালিয়ে যাই আর কি।” তাঁদের অসুস্থ লোক লেখলেই অসহ্য বোধ হয় আর অপারেশন থিয়েটারও খুব বোরিং মনে হয়। আমি নিষ্পাপভাবে তাঁদের কাছে জানতে চাই, “নার্স হলে কেন তবে? অন্য কিছু হতে পারতে?” তখন তাঁরা উত্তর দেয় “আর কিই বা হতে পারতাম নার্স হওয়া ছাড়া!”আমি নিজে কোন কাজে এতো বিতৃষ্ণা বোধ হলে কিছুতে চালিয়ে যেতে পারতাম না। তেমনি তাঁরাও ছেড়ে দিলেই পারে! ভালোই যখন লাগে না তবে সেই কাজ করা কেন?! এক মাসের নোটিশেরই তো ব্যাপার। দিয়ে দিলেই হয়। একই কথা বলতে হয় খাবার নিয়ে। খাবার নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেয় কিন্তু পরিমাণে বরং একটু বেশিই খাবে। আমি অনেকের কাছে জানতে চেয়েছি তাঁদের এই পেশা বেছে নেবার পেছনে কি কারণ কাজ করেছে? কেউ কেউ বলেছে অসুস্থ হয়ে কিংবা রোগী দেখতে হাসপাতালে এসে নার্সদের দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। কেউ কেউ বলেছে বাড়ির কড়া শাসনের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে নিজের মত করে থাকার বাসনা। যুদ্ধও অনেককে এই পেশার দিকে ঠেলে দিয়েছে। অনেকে বিবেচনায় এনেছে নার্সিংই একমাত্র পেশা যে পেশায় কোন পূর্বঅভিজ্ঞতা ছাড়াই বিনামূল্যে থাকা খাওয়ার পাশাপাশি বিনামূল্যে ট্রেনিংও জুটে যায়। আমার কখনো এমনটি মনে হয়নি শিক্ষানবিশদের বেতন খুব কম। অধিকন্তু তাঁরা থাকা খাওয়া, ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি বিনামূল্যে ইউনিফর্ম এবং চিকিৎসা সুবিধা অবধি পেয়ে থাকে। অবশ্য একজন পূর্ণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সের বেতন একজন উঁচুদরের পার্লার মেইডের থেকে বেশি নয়। টানা তিন বছর কঠোর শ্রমের পর যে জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা তাঁরা আয়ত্ব করে তাতে সেই বেতন নুন্যতম ছাড়া আর কিছু নয়।

যদিও আমার অনুভূতি শিক্ষানবিসের বেতন এমন কিছু কম নয় তবুও যখন এনভেলাপে ভরে মাসের শুরুতে টাকাকটি হাতে আসে তখন অন্য সবার মতই আমারও কিছুটা হতাশ লাগে। রেডউডে বিনোদনের আহামরি বন্দোবস্ত না থাকলেও টাকা চাইলে যেকোন জায়গাতেই খরচ করা যায়। অবশ্য ভাল সিগারেট, স্টকিংস এবং স্ট্যাম্প পয়সা দিলেও সবখানে মিলে না। তবে পয়সা দিলে খাবার সবখানেই মিলে। মাসের শুরুর দিকে পকেটের অবস্থা যখন খুব ভাল থাকে আমরা গিয়ে বসি ব্লুলেডী ক্যাফেতে নয়তো বিডলস রেস্তোরাঁয়। কখনো কখনো ডিপার্টমেন্ট স্টোরস হুপারসের দোতলায় যে টি রুম আছে  সেখানে। সমগ্র রেডউডে ওইটাই একমাত্র জায়গা যেখানে টেবিলে টেবিলক্লথের পাশাপাশি ফুলদানিতে ফুলও মেলে। মাসের শেষের দিকে “জক্স বক্সে” নয়তো “জ্যাক স্ন্যাক্সে” খাই ফ্রায়েড ফিশ, ঠাণ্ডা ম্যারম্যারে চিপস, স্যান্ড কেক(যা খেতে অনুভূত হয় সত্যি বুঝি বালি দিয়ে বানানো) এবং বোতল থেকে ঢালা সিরাপের মত কফি। কিন্তু ওই দোকানের নয় পেনি দামের বিন এবং সসেজের স্বাদ দুর্দান্ত। “রোয়ান আর্মিতে” আমরা কখনো যাই না। কারণ সেখানে খাবারের দাম সব সময় অপরিবর্তিত থাকে আর সেখানে আছে আদ্যিকালের দুজন ওয়েটার তাঁদের মধ্যে আছে টেইলকোট পড়া ইডিয়ট এক ছেলে । আসলে “রোয়ান আর্মি” আমাদের স্টাইলের সাথে মিশ খায় না। তবে “রোয়ান আর্মি”র দোতলায় একটা কজি বার আছে। সেই বারের মেইড একবার উইলিয়াম ফরেস্ট ওয়ার্ডে ভর্তি ছিল। তাই আমি আর পেরি কোন বিশেষ দিনে ইউনিফর্মের উপর কোট চাপিয়ে সেই বারে গিয়ে বসি।

দুজনের ক্রিশ্চিয়ান নামের বদৌলতে কিনা জানি না এতদিনে এসে আমার এবং পেরির বন্ধুত্ব এক অপূর্ব মাত্রা পায়। পেরির ক্রিশ্চিয়ান নাম ক্রিস। আমার ওকে এতোটাই ভাল লাগে ভেবে পাই না শুরুতে তাঁর প্রতি আমার এই অনুভূতি কি করে ঋণাত্মক ছিল। ঈর্ষা? তাই হবে বোধ করি কারণ ওকে দেখে আমার মনে হত এই হাসপাতালই বুঝি ওর বাড়িঘর। ও বুঝি এখানেই বেড়ে উঠেছে। ওর তুলনায় নিজেকে আমার মনে হত উটকো। ও অবশ্য বলে আমাকেও প্রথমে ওর অতটা ভাল লাগেনি। আমাকে মেজাজি আর অহংকারী ভেবেছিল ও। একদিন রাতে কাছের বিমানবন্দরটি থেকে ভীষণ গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসতে থাকলে আমি ক্রিসের রুমে যাই একটু সঙ্গ পেতে। সেদিন আমাদের আড্ডা এতোটাই জমে উঠেছিল যে তা সারারাত ভর চলতেই থাকত যদি না নার্স গ্রেইঙ্গার তাঁর সাথে নার্স লারকিনের প্রাক্তন প্রেমিক গ্যানডারের সাথে নিজের বিয়ের তাজা খবর নিয়ে হাজির হত। গ্যানডারের পাকস্থলীর অর্ধেকটা অপারেশন করে কেটে ফেলা হয়েছে। সে হার্বার্ট ওয়াটারল ওয়ার্ডে ভর্তি ছিল।

নার্স জীবনের পরিক্রমার ঠিক এই সময়টিতে এসে নিজেকে আমার সত্যিকারের সুখী মনে হয়। আমার ভীষণ আমুদে এক বন্ধু জুটেছে ক্রিস। তাঁর সাথে জুটি বেঁধে সারাদিনভর কাজ করলেও কাজকে আমার আর কাজ মন হয় না। আরও দুএকজনের সাথে অন্তরঙ্গতা হয়েছে যাদের সাথে প্রানখুলে হাসা যায়। আমি আর ওয়ার্ডের সবচেয়ে জুনিয়র নার্সটি নই এটাও এক ধরনের সুখের অনুভূতি দেয়। দিনে দিনে আমার ওয়ার্ডের কাজগুলি আমি ভালই রপ্ত করে নিচ্ছিলাম। নার্সিংয়ের দুয়েকটি বেসিক নিয়মও হাড়ে-মজ্জায় সেঁধিয়ে যাচ্ছিল।

আমার এই অতিসুখ বেশীদিন সইল না। একদিন সন্ধ্যায় একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স আমাকে তাঁর রুমে ডেকে পাঠাল। রুমে ঢুকেই তাঁর ব্যাপারে আমার একটা নাখোশ ইম্প্রেশন তৈরি হল। বেসিনে বাসি চায়ের পাতা জমে আছে। কাপবোর্ডে কায়দা করে হ্যাঙ্গার ঝুলিয়ে তাতে অন্তর্বাস শুকাতে দেয়া। সে অনেক কসরত করে তাঁর আঁটসাঁট ইউনিফর্মে লাগানো সেফটিপিন খুলতে খুলতে আমার সাথে কথাবার্তা চালাচ্ছিল। সে আমাকে বলল, “তোমার জানা দরকার যে, সিনিয়র কোন নার্সের সাথে বন্ধুত্ব করে পপুলার হওয়ার চেষ্টা করা ঠিক না”

আমি বললাম, “তুমি কি নার্স পেরির কথা বলছ?!”

সে হেসে বলল, “কাম অন!আমি কারো নাম নিতে চাইনা!শুধু তোমাকে জানানো প্রয়োজন মনে করলাম তাই বললাম।”

আমি বললাম, “কিন্তু পেরি ছাড়া আর কারো সাথে তো আমার বন্ধুত্ব নেই?”

সে বলল, “তুমি তোমার ব্যাচের আর কারো সাথে বন্ধুত্ব কর না কেন? যেমন ধর গুন্টার।”এই বলে সে আমার সামনেই কাপড় পাল্টানোর প্রক্রিয়া শুরু করতেই আমি তারাতারি সেখান থেকে কেটে পরলাম। বিস্ময় কেটে যেতে যেতে ভাবতে থাকলাম ক্রিসের সাথে কত তাড়াতাড়ি এই বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। ক্রিস সেদিন রাতে এয়ারফোর্সের একজন অফিসারের সাথে বাইরে গিয়েছে। সকালের আগে তাঁর সাথে আমার দেখা হবে না। ভাবলাম, দুজনে মিলে যখন ওয়ার্ডে বিছানা তৈরি করব তখন তাঁকে কথাটা বলব। নয়তো দুজনে মিলে যখন বেচারি মিসেস মুরের মরফিন ইনজেকশনটা দেব তখনই বলা যাবে কথাটা। আমি ইতিমধ্যে ভাবতে শুরু করেছিলাম যে ক্রিস হল স্নো হোয়াইট আর আমি হলাম টিঙ্কার বেল।

ভুলেই গিয়েছিলাম আজ মাসের প্রথম দিন। ভীষণ কান্না পেয়ে গেল যখন নাইট সিস্টার ঘোষণা করল যে, আমাকে সেদিন থেকেই হার্বার্ট ওয়াটারল তে কাজ করতে হবে। একেই বলে নিয়তি। গুন্টার টেবিলের ওপাশ থেকে ফিসফিস করে বলল যে সে এখনো ঐ একই ওয়ার্ডে আছে এই বলে সে এক আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিল। আমি দুর্বল হাসি হেসে তাঁর হাসির প্রতিউত্তর করলাম। তারপর খুবই অপ্রীত মন নিয়ে পুরুষ রোগীদের সার্জিকাল ওয়ার্ড হার্বার্ট ওয়াটারলতে ঢুকলাম। এমনকি ওয়ার্ডের সব রোগীদের উপরও আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল উইলিয়াম ফরেস্টের সব সিনিয়রদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বলেই ওরা আমাকে সরিয়ে দিয়েছে। করুণা হয় আমার এইসব জটিল মনস্তত্বের মহিলাদের উপর। অবশ্য তারচেয়ে দশগুণ বেশি করুণা হল আমার নিজের উপর। ঠিক আছে আমিও দেখে নেবো ভঙ্গিতে কাজ শুরু করলাম। সিস্টার ছুটিতে থাকায় ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছে সাওয়ারবি নামের একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স। তাঁকে সবাই ডাকে “স”বলে। যে কাজগুলো এড়ানো সম্ভব নয় শুধু সেকাজগুলিই করছিলাম আর রোগীদের ভীষণ মুখ ঝামটা দিচ্ছিলাম। রোগীদের নাম এবং তাঁদের ব্যাবস্থাপত্র ইত্যাদি এসব কিছুই মনে রাখার ইচ্ছা অথবা মনে রাখার চেষ্টা আমার মধ্যে কাজ করছিল না। গুন্টার যথারীতি আমার পায়ে পায়ে ঘুর ঘুর করছিল। গুন্টারের সাথের অন্য নার্সটি ছিল ভীষণ নিষ্প্রাণ দেখতে। “রছ” নামের একজন স্কচ নার্স অতি বিশ্রীভাবে আমার উদ্দেশে বলল, “উইলিয়াম ফরেস্টের কোন নোংরা নিয়ম এখানে খাটবে না।” প্রথম দিনেই দুজন দুজনের শত্রু বনে গেলাম। রছের দাঁতগুলি বিশ্রী হলুদরঙের আর হাতের কব্জি বেজায় লাল।

দিনটি যেন কিছুতেই আর শেষ হতে চাইছিল না। আমি বার বার ঘড়ি দেখছিলাম। বিকাল সাড়ে পাঁচটা বাজতেই হাতের কাজ ফেলে রেখে মিসেস সাওয়ারবির অনুমতি নিয়ে ওয়ার্ডের দিকে দৌড় দিলাম। মাঝপথে নার্স রছ এসে থামাল। মনে করিয়ে দিল সিঙ্কে ফেলে আসা আমার অসমাপ্ত কাজের কথা সেই সাথে পুনরাবৃত্তি করল,উইলিয়াম ফরেস্টের কোন নোংরা নিয়ম এই ওয়ার্ডের জন্যে নয়!! সিস্টার মারটিন সিস্টার লুইসের মত নয় ইত্যাদি। সিঙ্কের কাছে ফিরে যেতে যেতে চোখটা ভীষণ জ্বালা করে উঠল। চোখের পানি বাঁধ মানতে চাইল না। প্রতিহিংসার বশে মনে মনে চাইলাম সে যেন কোন রোগীকে ভুল ওষুধ দেয় তারপর সবার সামনে ভীষণভাবে অপদস্থ হয়! পরের দিন আমার ছুটি।এই বিশাল পৃথিবীতে যখন ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠলাম আগের দিনের সব টুকরা টুকরা ঘটনা মনে পড়ে গেল। নিজের সংকীর্ণ আচরণের কথাও মনে পড়ল। যাদের মত কোনদিন হতে চাইনি গতকালের দিনটি ঠিক তাদের মত করেই কাটিয়েছি। অনুশোচনা হল। স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানালাম এই ছুটির দিনটির জন্য আর চমৎকার গভীর একটা ঘুমের জন্য। যখন আবার হার্বার্ট লতে ফিরলাম, মনে মনে প্রস্তুত হলাম ওয়ার্ডটিকে ভালবাসার চোখ দিয়ে দেখার। আবিস্কার করলাম আমি আসলে হাসপাতালের সবচেয়ে সেরা ওয়ার্ডটিতে কাজ করবার সুযোগ পেয়েছি। আর আমার ওয়ার্ডের রোগীরাও সব লাভেবল ক্রিয়েচার। প্রথম দিনের ইমপ্রেশন কাটাতে আমাকে রীতিমত একজন কালো ক্রীতদাসের মত খাটতে হল।

ওয়ার্ডে সব সময়ই কিছু না কিছু ঘটে চলেছে। এই ওয়ার্ডেই সব ক্যাজুয়ালিটি এসে ভর্তি হয়। অপারেশনের রোগী, দুর্ঘটনার রোগী,সুইসাইড কেস, এমনকি মাতালেরাও। হাসপাতালের বিশ মাইলের ভেতর যত দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে সেসব দুর্ঘটনায় আহতেরা সব এই হাসপাতালেই আসে। সকালবেলাটা খুব একসাইটিং কাটে কারণ প্রতি রাতেই নতুন নতুন রোগী ভর্তি হয়, কোন রাতই খালি যায় না। গ্যাস্ট্রিক আলসারের রোগী যেমন আছে তেমন আছে মুমুর্ষ, অচেতন স্যালাইন প্রাপ্ত রোগীও। এইরকমই একজন রোগীর নাম স্কটি। মালবোঝাই লরির নিচে চাপা পড়েছিল সে। শুধু চোখদুটি দেখেই অনুমান হয় এটা মানুষের মুখ। দৈত্যের মতন লম্বা, মাথাভরা লালচুল কাঁধ অবধি নেমে এসেছে। স্যালাইন চলছে। শুধুমাত্র খাবার খাওয়া ছাড়া আর কোন মানবিক অনুভূতির প্রকাশ তাঁর মাঝে নেই।সপ্তাহ দুয়েক সে শান্ত বালকের মত শুয়ে কাটাল।তাঁর ছোটখাট গড়নের বেজায় শক্ত মনের বউটি প্রতিদিন এসে তাঁকে দেখে যেত আর তাঁর সাথে এক তরফা কথা চালিয়ে যেত এই আশা মনে নিয়ে যে স্কটি তাঁকে সাড়া দেবে। মাঝে মাঝে অনুমতি সাপেক্ষে তাঁর ছোট্ট শিশুটিকেও সে নিয়ে আসত , বাবার নাকের নিচে তাঁকে নাচাত এই আশায় স্কটি নিশ্চয়ই সাড়া দেবে!! কিন্তু সে তাঁর নীল চোখজোড়া দিয়ে শূন্য নিষ্পলক চোখে তাঁদের পানে তাকিয়ে থাকত। আমি একদিন তাঁকে তরল খাবার খাওয়ানোর সময় আমার মনে হল সে বুঝি আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসল আর চোখের পলকও ফেলল। আমি দৌড়ে গেলাম সিস্টারকে এই সুখবর জানাতে। সিস্টারকে খুঁজে পেয়ে তাঁকে নিয়ে স্কটির বেডে ফিরতে ফিরতে আবিস্কার করলাম সে আগের চেয়েও অচেতন অবস্থায় ফিরে গিয়েছে। সিস্টার আমাকে সম্ভাব্য উপসর্গ বিষয়ক এক লম্বা লেকচার দিয়ে এবং স্কটির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দিয়ে বিদায় নিল। তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর বাচ্চার কথা মনে করেই বুঝি একদিন তাঁর চেতনা ফিরে এলো। সে দুইহাত মেলে কেঁদে উঠল, “উইই জেনি!!! ” কিন্তু স্ত্রীর কথা ভেবে সে যার স্কার্ট আঁকড়ে ধরেছিল সে আর কেউ নয়। সে ছিল গুন্টার!!

ওয়ার্ডটিতে কাজের কোন শেষ নেই। আমরা যতজন রোগী দেখভাল করতে সক্ষম মোট রোগীর সংখ্যা সবসময় তারচেয়ে বেশি থাকে। নতুন নতুন রোগী প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু কোন না কোনভাবে অবশ্য ম্যানেজও হয়ে যায়। অফ ডিউটিতে যেতে প্রতিদিনই দেরি হয়ে যায়। কিন্তু নার্সেরা কিছু মনে করে না কারণ পরিস্থিতির গুরুত্ব এবং একজন নার্স হিসেবে আমাদের দায়িত্ববোধই আমাদের উক্ত সময়গুলোতে আটকে রাখে। এই কঠোর শ্রমের প্রাপ্তি হল রোগীদের সাথে গভীর বন্ধন। শুধু আমি নই ওয়ার্ডের প্রতিটি নার্সই প্রয়োজনের অতিরিক্ত শ্রম দেয়। সাওয়ারবি, নার্স রছ, নতুন নার্স রবিন, নার্স হাওয়েস, এবং গুন্টার। নার্স রবিন সারাক্ষণ খিলখিল হাসে আর কথা বলার সময় রোগীদের গায়ে প্রায়শই চাপড় মারে। , নার্সিং এ ভীষণ দক্ষ রছ, নার্স হাওয়েস ভীষণ পরিচ্ছন্ন স্বভাবের। তাঁর এপ্রন সব সময় দাগমুক্ত থাকে। অল্পকিছুদিন যেতেই পরিস্কার হল এই অসাধারণ কর্ম পরিবেশ তৈরির নেপথ্যে যে আছে সে হল সিস্টার মার্টিন। সে কখনোই নার্সদের পেছনে বিশ্রীভাবে লেগে থাকে না বরং তাঁদের ভেতর একধরণের কর্ম উদ্দীপনা তৈরি করে দেয়। আর এভাবেই সর্বোচ্চ কাজ হাসিল হয়। এই ওয়ার্ডের নার্সেরা অসম্ভব ইউনিটি নিয়ে কাজ করে। নার্স মার্টিন একটা রেয়ার স্পেসিমেন। এরকমটি সচরাচর দেখা যায় না।

তাঁর মত এত প্রাণশক্তিতে ভরপুর মানুষ আমি আর কোথাও দেখিনি। এক একজন রোগী তাঁর কাছে এক ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ। নার্সদের মধ্যে একটি মিথ প্রচলিত আছে তা হল ফ্যানি মার্টিন যমের দুয়ার হতে মৃতকে ফিরিয়ে আনতে পারে। সে একবার টানা পাঁচদিন অফ ডিউটিতে না গিয়ে সকাল আঁটটা হতে রাত দশটা অবধি টানা এক মৃতপ্রায় রোগীর পাশে কাঁটাল যেন ঐ রোগীর সেবা করাই তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। রোগীটি মারা যাবার পর দৌড়ে গিয়ে এপ্রন পাল্টে এসে বৃদ্ধ হস্কিন্সের দায়িত্ব নিল। হাউজ সার্জন হস্কিন্সের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছেড়ে দেবার পাত্রী সিস্টার মার্টিন না। একবার হাউজ সার্জন একজন রোগীকে না দেখেই ডিনারের বিরতিতে চলে গেলে সে (সিস্টার মার্টিন) ওই সার্জনকে আবার ওয়ার্ডে টেনে নিয়ে আসে রোগীটিকে দেখতে। সেই একমাত্র সিস্টার যে ডাক্তারদেরকে হিরোওরশিপ না করে বরং সবাইকে সমান চোখে দেখে এবং তাঁদের(ডাক্তারদের) কোন ভুল হলে তা সামনে বলতে দ্বিধা করে না। কিন্তু সার্জনরা সবাই তাঁকে ভীষণ পছন্দ করে। একদিন দেখি সার্জন হার্ভে ওয়াটকিনস কথাচ্ছলে মিস মার্টিনকে চিমটি কাটছে। আমি সিস্টারকে সেদিন নতুন চোখে আবিস্কার করলাম। মনে হল চিমটি খাবার তুলনায় সেযেন একটু বেশি তন্বী। সে যদি কোথাও দুদণ্ড স্থির হয়ে দাঁড়াত তবে চোখে পড়ত তাঁর মত সুন্দরী মেয়ে খুব কমই আছে।

কাছের বিমানবন্দরটিতে কনসার্ট উপলক্ষে ক্রিসের প্রেমিক এয়ারফোর্স অফিসার ক্রিসকে বলেছে দুএকজন বন্ধু সাথে নিয়ে যেতে। ক্রিস আমাকে আর বার্নেটকে বলেছে ওর সাথে যেতে। আমি প্রথমে বলেছিলাম যাব না। ইদানিং ওয়ার্ডের পর এতোটাই টায়ার্ড থাকি! যে কয় মিনিট বাড়তি সময় পাই সিস্টার টিউটরের হোমওয়ার্কের পেছনে ব্যয় করি। ডিউটির পর বাথটাবে শুয়ে শুয়ে একজন রোগীর কাছ থেকে ধার করা খবরের কাগজ পড়ি আর গোসলের পর বিছানায় টুপ করে ঝরে পরি। ক্রিস আমার না যাবার কথা শুনে আমাকে ব্যঙ্গ করে সমগ্র পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক প্রানি হিসেবে। সে আরও বলে আমি নাকি ইদানিং পরিনত হয়েছি সোশ্যালি প্যারালাইজড এক ক্রিয়েচারে যে কিনা জনসমক্ষে বেরোতে ভয় পায়। ঠিক করলাম কনসার্টে যাব। অনেক দিন হল কোথাও বেরোই না। তাই ডে অফের পুরোটা সময় কাটালাম এতদিনের অবহেলিত নখ এবং চুলের যত্ন নিয়ে। অবশ্য ওইদিনই ওয়ার্ডটি ব্যস্ততম ওয়ার্ড হয়ে উঠল।দুটি ইমারজেন্সি কেস ছিল অপারেশনের জন্যে আর একজন ক্যাজুয়ালিটি ভর্তি হল সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায়। যে আর জ্ঞানই ফিরে পেল না, অচেতন অবস্থাতেই মারা গেল। সন্ধ্যার পর থেকেই বার বার ঘড়ি দেখছি আর ভাবছি, কিছুতেই আজ সাড়ে আঁটটার ভেতর শেষ করতে পারব না। ক্রিসের প্রেমিক আর্থার ঠিক নয়টায় আমাদের নিতে আসবে তাঁর ছোট্ট অস্টিনে করে । সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় অবশেষে পৌনে নয়টায় কাজ শেষ করে ওয়ার্ডে ফেরার প্রস্তুতি নিলাম।ক্লান্তিতে পুরো শরীর ভেঙ্গে পরতে চাইছে। কনসার্টে যাবার কোন ইচ্ছাই আর অবশিষ্ট নেই। ঘুম এবং বিছানা এই দুটিকে ছাড়া আর কোনকিছুর কথা ভাবতে পারছি না। সিস্টারের কাছে বিদায় নিতে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে বুড়ো হসকিন্স ডাকল। আমি না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছি এমন সময় পাশের বেডের রোগীটি চেঁচিয়ে উঠল, “হসকিন্স তোমাকে চায় নার্স!

বুড়ো হসকিন্সকে কায়দা করে বিছানায় শোয়াতে রাত প্রায় নয়টা বেজে গেল। সিস্টারের সামনে গিয়ে, “প্লিজ সিস্টার , মে আই- ” বলা শুরু করতেই সিস্টার আমাকে শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠল, “প্রায় শেষ নার্স? তুমি পলিওমাইলেটিসের বাচ্চাটার পা টা ব্যান্ডেজ করেছো, তাই না? ” আমি ওই রোগীটির কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। “এখুনি যাচ্ছি” বলে মনে মনে শাপান্ত করতে করতে উদ্দিষ্ট রোগীর পানে নিজেকে টেনে নিয়ে চললাম। তারপর এমন শক্ত করে ব্যান্ডেজটি করলাম যেন ক্ষুদে শয়তানটা লাথি মেরে আর তা খুলে ফেলতে না পারে। রুমে ফিরে যখন তৈরি হচ্ছি তখন ক্রিস ইতিমধ্যে আমার রুমে বার ছয়েক ঢুকেছে এবং বেরিয়েছে।অবশেষে বাইরে গিয়েছে অপেক্ষারত অধৈর্য হয়ে ওঠা আর্থারকে শান্ত করতে।আর্থার বেচারা কনসার্ট মিস হয়ে যায় ভেবে আমাদের ফেলেই চলে যায় আর কি? আমি তাড়াহুড়া করে কোনরকমে তৈরি হয়ে গাড়ির পেছনের সীটে বার্নির কোলের উপর ধুপ করে বসে পড়ি আর বার্নি চেঁচিয়ে ওঠে। অবশেষে অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তায় ঝাঁকি খেতে খেতে এরোড্রমের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি।

আমাদের সাথে আর্থারের আরও দুজন বন্ধু টম এবং নাইজারও যোগ দিল। আমরা প্রচুর ড্রিংক করলাম। আমি যে কি ভীষণ ক্লান্ত হয়েছিলাম তা আর আমার মনেই রইল না। মনে হল তা হয়তো অন্য কোন সন্ধ্যার অনুভূতি আর হাসপাতালকে মনে হল অ-নে-ক দূরের কোন রাজ্য। আমি ক্রিসকে চীৎকার করে জানালাম ও একদম ঠিক বলেছে , আমার মাঝে মাঝে বাইরে আসা উচিত। ক্রিস হেসে উত্তর দিল, “শাট আপ!! ওখানে এক ভদ্রলোক গান গাইছে!!!”একটা হ্যাঙ্গারে সারি সারি সাজানো চেয়ারে আমরা লাইন দিয়ে বসেছি। ইউনিফর্ম পরিহিত প্রকাণ্ড চেহারার এক অফিসার ইউনিয়ন জ্যাকের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুদে, মুষ্টিবদ্ধ হাতে গেয়ে চলেছে, “দেয়ার উইল অলওয়েজ বি এন ইংল্যান্ড -”। গানটা শুনে মনে হচ্ছে সুরটা কেউ তাঁর গলা দিয়ে পাম্প করে বের করছে। তাঁর গান শেষ হলে একজন পাইলট সার্জেন্ট ট্যাপ ড্যান্স করল। সে নিশ্চয়ই খুব জনপ্রিয় কারণ তাঁর নাচের সাথে দর্শকরাও তালে তালে নিজেদের পা নাচাচ্ছিল আর শিস দিচ্ছিল। তারপর এক ছোটখাট বালক চেহারার একজন এক আবৃত্তি করে শোনাল। তারপর বিরতির সময় হল। আমরা আরও ড্রিংক করলাম আর সাথে খেলাম সসেজ রোল। আমি কনসার্টের বাকীটা মিস করলাম কারণ ঘন কোঁকড়া চুলের নাইজার আমাকে রীতিমত জোর করল তাঁর সাথে তাঁর এরোপ্লেনটি দেখতে যেতে। এরোপ্লেনটি একটি স্যাঁতস্যাঁতে মাঠে দাড় করিয়ে রাখা ছিল। আমি আমার রাতটা দারুন কাটালাম।

ভোর ছয়টার চিন্তা উত্তেজনা কমিয়ে মনকে শান্ত রাখল। ফেরার পথে আমি আর বার্নি দুজন দুজনকে বালিশ বানিয়ে ঘুমালাম। সবেমাত্র একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি এমন সময় আর্থারের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গল। সে বলল, “তোমরা কি এইবার নামবে?! গাড়ি এর চেয়ে বেশিদূর যাবে না!!”সে গাড়িটা হাসপাতালের ঠিক সামনেই পার্ক করেছে। আমরা আধো ঘুমে আধো জাগরণে গাড়ি থেকে নামলাম। বাইরে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। রাতের ভেলভেটের মত কালো আকাশ অসংখ্য তারার আলোয় ঝলমল করছে। কিন্তু রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করবার মত শারীরিক বোধ কারোরই নেই। মাথায় একটিমাত্র চিন্তা ঘুরছে- কতক্ষণে বিছানার দেখা পাব। হাসপাতালের মূল গেইটটি খোলা। কিন্তু তবুও আমরা চুপি চুপি ছোট গেইটটি দিয়ে ঢুকলাম আর গুটিসুটি পায়ে এগোচ্ছিলাম হোস্টেলের বাথরুমের খোলা জানালাটি লক্ষ্য করে। ক্রিস ফিসফিস করে বলে উঠল, “হায় খোদা ! নাইট নার্সেরা এতো ব্যস্ত কেন?!” সদর দরজায় দুটি এ্যাম্বুলেন্স পার্ক করে রাখা। আরও একটি এ্যাম্বুলেন্স আমাদের পর পরই এসে ঢুকল। এম্বুলেন্সের মাথার বাতিটি নুড়ি বিছানো পথের উপর ক্রমাগত আলোর বৃত্ত এঁকে চলেছে। আমি বললাম, “বাজি ধরে বলতে পারি এই রোগীরা সব হার্বার্ট ল তে যাচ্ছে!” বুঝতে পারছিলাম না ঘটনা কি ?! সেদিন রাতে তো কোন এয়ার রেইডের ঘটনাও ঘটেনি! আমরা দূর হতে দেখতে পেলাম ছায়ার মত অবয়বগুলো স্ট্রেচার হাতে নড়াচড়া করছে। ল্যাম্পের ঝাপসা আলোতে তাঁদের নড়াচড়া আর ফিসফাস কথাবার্তা নুরি বিছানো পথের উপর কেমন এক রহস্য তৈরি করে চলেছে। মনে হয় যেন সিনেমায় ঘটে যাওয়া কোন দৃশ্যপট। আমরা পা টিপে টিপে আমাদের উদ্দিষ্ট খোলা জানালা লক্ষ্য করে এগিয়ে চলি। কোথাও হোঁচট খেয়ে খিলখিল হেসে উঠি। শীতে কেঁপে কেঁপে উঠি। অবশেষে জানালাটি খুঁজে পেলে খুব সাবধানে আস্তে চাপ দিই যাতে ওটার ক্যাঁচক্যাঁচ আর্তনাদে আমাদের অগমনি প্রকাশ না হয়ে পড়ে। ক্রিস বাথরুমে পৌঁছে যেতেই শুনতে পাই কেউ বলছে, “সারা পৃথিবী খুঁজে শেষে কিনা এইখানে!?! কাম অন!! জলদি আস!! দয়া করে এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না!! সবার জন্যে জরুরী কিছু অপেক্ষা করছে!!” আমি বার্নির পেছন পেছন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জানালা বেয়ে উঠি। বাথরুমে ঢুকেই এক কোনে মেঝেতে ধুপ করে বসে পায়ের জুতাজোড়া পায়ে গলাতে থাকি আর ভাবি যত জরুরীই হোক আমাকে বিছানায় যেতেই হবে। প্রথমে খেয়াল করিনি প্যাসেজের নীলবাতিগুলি সব জ্বালানো। সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠানামা করছে, ছুটাছুটি করছে আর ডাকাডাকি করছে! পুরো হোস্টেল জেগে আছে! অন্য কোন সময় রাত দুইটায় এই হোস্টেল এক মৃতপুরী বইতো নয়! ভাবছিলাম কেউ দেখে ফেলার আগেই চুপি চুপি বিছানায় সেঁধিয়ে যাব। কিন্তু করিডোরে এসে যেই বাক নিয়েছি ওমনি কেউ আমার বাহুটা খামচে ধরল।সে আর কেউ নয়, নার্স রছ অর্ধেক ইউনিফর্ম গায়ে চাপানো তাঁর। মনে হয় না সে দেখতে পেয়েছে আমার পরনে বাইরের পোশাক।

এক নিঃশ্বাসে দম আঁটকে সে বলল, “এইবার পেয়েছি! এখুনি ইউনিফর্ম পরে সোজা ওয়ার্ডে চল।”

আমি বললাম, “কি?!”

সে বলল, “তাড়াতাড়ি কর!”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে?”

কিন্তু ততক্ষণে সে উধাও হয়েছে। রবিনের রুম খোলা পেয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে রবিন?!”

এপ্রনে সেফটিপিন লাগাতে লাগাতে সে চোখ বড় বড় করে বলল, “কি হয়েছে তুমি জানো না!?! কাছের একটি কারখানায় ভীষণ ভয়ংকর এক দুর্ঘটনা ঘটেছে। পুরুষ ওয়ার্ডের সবাইকে এখুনি যেতে হবে। শুনলাম বিশটির মত বার্ন কেস আসছে খুব শীঘ্রি।”

কিভাবে রুমে ঢুকলাম আর কিভাবে ইউনিফর্ম পড়লাম জানি না। ক্লান্তিতে আমার কান্না পাচ্ছিল। মাথায় ভয়ানক ব্যাথায় মনে হচ্ছিল যেন মাথার শিরাগুলি সব ছিরে যাবে। আধখোলা চোখে আয়নায় নিজেকে খুব বুড়োটে আর নিষ্প্রাণ দেখাল। চেহারা দেখে নার্স নয় রোগীই মনে হল নিজেকে। এমনকি দুহাত উপরে তুলে যে মাথার ক্যাপটি ঠিক করে বসাব সেই শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই শরীরে। সাটিনে মোড়ানো কোন আরাম কেদারা নয় আমাকে টানছিল আমার লম্বা পায়াওয়ালা লোহার বেডটি। পরিস্কার এপ্রন খুঁজে নেবার ধার না ধেরে খুঁজে পেতে একটি ময়লা এপ্রনই গায়ে চাপতে চাপাতে চিন্তা করলাম ওয়ার্ডে গিয়ে কত দুঃসাধ্য হবে জেগে থাকা!

ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি, পুরো ওয়ার্ডটিই একটি বিশৃঙ্খলা হয়ে উঠেছে। সবগুলি বাতি জ্বলছে। এমনকি সব রোগীরাও জেগে আছে এবং অবাক চোখে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছে। নাইট নার্সেরা আমাদের ডে নার্সের আগমনে খুব খুশি না হয়ে পরস্পর বলাবলি করছে তাঁরা ঠিকই সামলে নিতে পারতো আমাদের যোগ দেয়াটা ততটা জরুরী ছিল না। তবে আমাদের আগমনে তাঁদের কাজের বোঝা যে কিছুটা হাল্কা হল এতে তাঁদের আচরণে আংশিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেল। ওয়ার্ডের শেষপ্রান্তে বাড়তি শয্যা সংযোজিত হল। যে রোগীদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভাল তাঁদেরকে ঐসব নতুন সংযোজিত বেডে সরিয়ে নেয়া হল। দশটি খালি বেড তৈরি করে রাখা হল পুড়ে যাওয়া রোগীদের কথা ভেবে। ইতিমধ্যে চারজন ক্যাজুয়ালিটি এসে পড়েছে আর প্যাসেজের মেঝেতে স্ট্রেচারে অপেক্ষারত আছে আরও একজন। সিস্টার মার্টিন তাঁর পাশে হাঁটুগেড়ে বসে আছে। আমি তাঁদের পাশ কাটানোর সময় সিস্টার আমার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠল, “তাড়াতাড়ি নার্স! তাড়াতাড়ি হাইপোডারমিক ট্রে আর এড্রেনালিন এনে দাও!কুইক!” কিন্তু সেসব যোগাড় করে আনতে আনতেই দেখি সিস্টার উঠে দাঁড়িয়েছে ওয়ার্ডে ফিরে যাবার জন্যে। আমার দিকে ফিরে করুণ হেসে বলল, “অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে! আর কিছু করার নেই!”ওয়ার্ডে ফিরে দেখি একটি বেডের তিনদিকে পর্দা দিয়ে ঘেরা ভেতর থেকে নার্স সাওয়ারবি বেরিয়ে এলো। তাঁর মুখ থেকে বেদনার কাতর শব্দ বেরিয়ে এলো। সিস্টারের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “ওহ সিস্টার! ওদেরকে এই ওয়ার্ডে কেন আনা হল? ওরা সব মৃত শরীর নিয়ে আসছে! আমরা এদের কি কাজে লাগবো? ওহ সিস্টার, আমরা এখন কি করবো? ঐ দেখো আরেকটি স্ট্রেচার এসে পড়েছে অথচ কোন বেডই তৈরি নেই-!”নার্স সাওয়ারবির মাথার চুল এলোমেলো হয়ে আছে। মাথার ক্যাপ একদিকে হেলে পরেছে। সিস্টার তাঁর উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “ প্লীজ নার্স স, নিজেকে সামলাও! খোদার ওয়াস্তে যদি নিজেকে শক্ত রাখতে না পারো তোমাকে জোর করে বিছানায় পাঠানো ছাড়া আমার আর কোন উপায় থাকবে না!”বেচারি স নিজের উপর নিয়ন্ত্রন ফিরে পেতে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে দম নিল বেশ কয়েকবার তারপর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো তাঁর ভঙ্গি। বাকি রাতটুকু সে ভীষণ দরদ মিশিয়ে, পাগলের মত সাধ্যের অতিরিক্ত শ্রম দিয়ে চলল আর সেইসাথে বাকি নার্সদের শান্ত থাকার পরামর্শ দিয়ে চলল। কিছু কিছু পোড়া খুব মর্মান্তিক নয় কিন্তু বাকি পোড়াগুলি শুধু দুঃস্বপ্নের অনুভূতি জাগায়, শিউরে তোলে সবার মন। তাঁদের সবাইকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। ওয়ার্ডের জানালায় এতক্ষণে ভোরের আভাস চোখে পড়ে। ব্লাইন্ডগুলি একে একে গুটিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মাঝে দুদণ্ড দাঁড়ানোর সুযোগ মেলেনি। সকালের আলো ফুটে ওঠার আগেই দুজন মারা গেল।

বিস্ফোরণটা কতটা ভয়াবহ ছিল তাই নিয়ে সবাই কথা বলছে। কেউ কেউ জল্পনা কল্পনা করছে আর বলাবলি করছে যে ওটা একটা স্যাবোটাজ ছিল, অবশ্য কেউই কোন প্রমান দিতে পারছে না।

সিস্টার আমাদের নার্সপ্রতি একজন করে রোগী নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আর নিজে বেডগুলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যখন যেখানে তাঁর প্রয়োজন পড়ছে তৎক্ষণাৎ হাজির হয়ে যাচ্ছে সেখানে। দরজায় আরেকটি স্ট্রেচার দেখা দিতেই সিস্টার আমার উদ্দেশ্যে বলল, “লোকটিকে দ্রুত বেডে ট্রান্সফার কর। ঐ যে ঐ বেডটি খালি আছে। তাড়াতাড়ি অপারেশন থিয়েটারেরে জন্যে তৈরি কর বেচারাকে। যত দ্রুত সম্ভব। আমি মিনিট খানেকের ভেতর আসছি-” কথা শেষ হবার পূর্বেই হাউজ সার্জেন্ট মিস্টার ব্রায়ান্টকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, “মিস্টার ব্রায়ান্ট! এক মিনিটের জন্যে এখানে আসুন প্লিজ!” বলতে বলতেই সিস্টার ডাক্তারের সাদা এপ্রনের কোনা টেনে ধরল।

ডাক্তার ব্রায়ান্ট বলে উঠল, “সেকার ওয়ার্ডের সবাই আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে সিস্টার!”

সিস্টার বলে উঠল, “ওরা অপেক্ষা করতে থাকুক।”এই বলে সে ডাক্তারকে টানতে টানতে পর্দাঘেরা বেডটির পাশে নিয়ে ঢুকালো। পোর্টার আর আমার মাঝখানে ছিল আমার জন্যে নির্দিষ্ট করা পোড়া মানুষটি। একগাদা কম্বল দিয়ে তাঁর শরীর ঢেকে দেয়া। আমি ভীষণ আতঙ্কিত অনুভব করলাম। এর আগে কখনো এতোটা পুড়ে যাওয়া শরির সামনে থেকে দেখিনি। আমার মানুষটিকে ছুঁতেও ভয় লাগছিল। আমি চারপাশে তাকালাম সাহায্যের আশায়, যদি কাউকে পাওয়া যায়। কিন্তু সবাই ভীষণ ব্যস্ত। শুধু আমাকে একা পুরো দায়িত্বটি সামলাতে হবে। হঠাৎই ভীষণ গর্বিত এবং উত্তেজিত বোধ করলাম। আমি একে মরতে দেব না!কিছুতেই না!

রোগীটি তখনো অচেতন। কিন্তু শ্বাস প্রশ্বাস চলছে। মুখখানি মোমের মত গলে গিয়েছে। দুঃস্বপ্নের নীল ছোপ পড়েছে তাঁর নাকে আর ঠোঁটে। আমি পালস দেখলাম। চলছে। মুখটি কেউ ছোয়নি তাঁর আর চোখদুটিও অক্ষত আছে। কিন্তু তাঁর শরীর -! আমি তাঁর কাপড় আলগা করে খুলে নিতে পারছিলাম না। ওভারঅলটি গায়ের চামড়ার সাথে পুড়ে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে কোন কোন স্থানে। আমি কাঁচি দিয়ে যতদূর সম্ভব কেটে কেটে তাঁর শরীর থেকে কাপড়ের টুকরাগুলো আলাদা করার চেষ্টা করলাম। ছেলেটির বয়স বেশি নয়। খাড়া নাক, সরু ঠোঁট আর বাদামী নরম চুল মাথায়। সিস্টার ইনজেকশন দিতে এসে আমাকে বলল আরও কম্বল দিয়ে ছেলেটিকে ঢাকতে। সে ভীষণ শক পেয়েছে তাই গরম পানির বোতল যোগাড় করতে। কাপবোর্ড খুঁজে দেখলাম একটি বোতলই অবশিষ্ট আছে। নার্স রবিনের হাতে আরেকটি বোতল দেখে তাঁর হাত থেকে বোতলটি ছিনিয়ে নিলাম। আমার পেছনে রবিন গাল বকে যেতে লাগল। পাত্তা না দিয়ে বেডের কাছে ফিরে যেতে যেতে দেখি মিস্টার ব্রায়ান্ট আমার রোগীটিকে দেখছে। তাঁকে বলতে শুনলাম, “এরা কেউই থিয়েটারে যাবার উপযুক্ত নয়। কিন্তু এভাবেও ফেলে রাখতে ঠিক ভরসা হয় না।”ডাক্তারের লম্বাটে চিবুকে না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি; চোখ দুটি না ঘুমিয়ে জবা ফুলের মত লাল হয়ে আছে। মনে পড়ল, নাইট নার্স বলছিল, মিস্টার ব্রায়ান্ট সারারাত জেগে আছে। রাতে তাঁর একটা সিজারিয়ান কেস ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, “ওকে যেভাবে হোক জাগিয়ে তোল। এখনো ওর চান্স আছে।” 

তাকিয়ে দেখি নার্স হাউয়েস অপারেশন থিয়েটার থেকে ওয়ার্ডের দিকে আসছে থিয়েটার ট্রলিতে করে তাঁর রোগীটিকে নিয়ে। অন্যসব দিনের মতোই দাগবিহীন এপ্রনে তাঁকে ভীষণ পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। তাঁর মাতৃমুখী মুখখনি অসম্ভব শান্ত হয়ে আছে। সে তাঁর রোগীটিকে বিছানায় শোয়াতেই আমি পোর্টারকে ধরলাম। বললাম, “এদিকে। এখন এর পালা। ”

পোর্টার বলে উঠল, “কিন্তু সিস্টার বলেছে, এরপর ঐ রোগীকে নিতে!”

আমি তাঁকে টানতে টানতে বললাম, “না না! সে এই রোগীটির কথাই বলেছে! সিস্টার আমাকে বলেছে এই রোগীর কথা- ” বলতে বলতে অনেকটা জোড় করে পোর্টারকে টেনে নিয়ে চললাম আমার রোগীটির কাছে। চারপাশের সবাই ভীষণ ব্যস্ত। তাই আমরা দুজনেই কোনরকমে ছেলেটিকে থিয়েটার ট্রলিতে শোয়ালাম। হঠাৎ সে চোখ মেলে চাইল। আমি তাঁকে বললাম, “হ্যালো”।

সে বলল, “লো” তারপর চোখ মুদে একটি ছোট শিশুর মত গুঙিয়ে উঠল।

এনেসস্থেটিক রুমে অন্য ওয়ার্ডের আরেকজন নার্স অন্য আরেকটি ট্রলি নিয়ে অপেক্ষা করছে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের ওয়ার্ডে কয়জন এসেছে?”

আমি বললাম, “দশজন। তোমাদের ওয়ার্ডে কয়জন এসেছে?”

সে বলল, “ছয়জন। সেকার ওয়ার্ডেও কয়েকজন এসেছে। তোমার রোগীর কোথায় পুড়েছে?”

আমি বললাম, “শরীর”

সে শিউরে উঠে বলল, “আমার রোগীটির মুখ আর চোখ পুড়েছে। তোমার ক্লান্তি লাগছে না?! খোদা! আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে!”

আমার মনে পড়ল, ঘণ্টা দুই আগের কথা। মৃতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমার একটুকুও ক্লান্তি ছিল না তখন। অবশ্য ক্লান্ত বোধ করার মত পরিস্থিতিও ছিল না!এখনো ক্লান্তি টের পাচ্ছি না। কয়েক ঘণ্টা আগের কথা মাত্র অথচ মনে হচ্ছে যেন কতযুগ হয়ে গেল!

অপারেশন থিয়েটারের স্লাইডিঙ দরোজা খুলে ওটি নার্স বের হয়ে এলো, মাস্ক পরা শুধু চোখ দুটি দৃশ্যমান। দরজার ফাঁক গলে ওটির যতটুকু চোখে পড়ে তাঁকে বিশৃঙ্খলা বললেও কম বলা হয়।

ওটির নার্স “হ্যালো” বলতেই টের পেলাম ওটা আসলে বার্নি। সে অন্য ট্রলিটি নিয়ে ওটিতে ঢুকে যাবার আগেই জিজ্ঞেস করলাম, “কি অবস্থা তোমার?!”

বার্নি, উত্তর দিল, “ভয়াবহ! কি একটা রাত গেল!” বলে বার্নি ভেতরে ঢুকতেই তরুণ চেহারার নতুন একজন হাউজ সার্জেন্ট গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলো।

আমার কাছে জানতে চাইল, “রোগীর পরিচয় জানা গেছে?”

আমি মাথা নাড়লাম।

ডাক্তারটি বলল, “এখানে বাইরে কিছু আত্মীয় স্বজন অপেক্ষা করছে। তাঁদের মধ্যে একজন মহিলাও আছে যে তাঁর স্বামীকে এখনো খুঁজে পায়নি। আমার মনে হয় থিয়েটারে নেয়ার আগে তাঁকে একবার দেখতে দেয়া উচিৎ।” তারপর সে তাঁর পেছনের দরজার ফাঁক গলে ডাকলেন, “ভেতরে আসুন মিসেস –র...”

সে ভেতরে ঢুকল। ছোট ছোট বাদামী চোখের এক মেঠো ইঁদুরের মত। কিছুদিন পরেই সে মা হবে।হাতের ছোট ব্যাগটি তাঁর পোয়াতি পেটটির উপর আলতো করে চেপে ধরে রাখা। পা টিপে টিপে সে থিয়েটার ট্রলির দিকে এগিয়ে গেল। একবার তাকিয়েই দম বন্ধ করে ফেলল,মাথা ঝাঁকাল একবার আমার দিকে আর একবার ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে। তারপর লাজুক গলায় বলল, “জ্যাক!” আলতো করে জ্যাকের মুখটা একবার ছুয়ে বলল, “ওর ঠাণ্ডা লাগছে নাতো?!”

ডাক্তার গলায় মাত্রাতিরিক্ত নিশ্চয়তা ঢেলে বলে উঠল, “সে একবারে সেরে উঠবে। আপনি নার্সকে তাঁর নাম এবং অন্যান্য বিবরণ জানিয়ে দিন। তারপর নিচে গিয়ে অপেক্ষা করুন।”

বউটি ফিসফিস করে বলল, “ওর আরেকটি নাম হল রপার”

ডাক্তার বলল, “ঠিক আছে আপনি সবকিছু নার্সকে বলুন। আমাকে এবার যেতে হবে-” বলে ভেতরে অনেকটা পালিয়ে গেল।

আমি এক টুকরা কাগজ জোগাড় করলাম রোগীর প্রয়োজনীয় বিবরণ লিখে রাখতে যাতে পরে রোগীর চার্টে তা তুলে নিতে পারি। মিসেস রপার খুব উদ্বিগ্ন হয়ে গুরুত্ব সহকারে আমাকে সাহায্য করল। সে বারবার করে তাঁর স্বামীকে ছুঁয়ে দেখছে যেন তাঁর বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে এমনটি ঘটেছে। সে এখনো এমন ঘোরে আছে যেন এই লোকটি এখুনি তাঁর নাম ধরে ডেকে উঠবে। যেন সে একটি স্বপ্ন দেখছে, জ্যাক নাইট শিফট থেকে ফিরে দাপিয়ে ঘরে ঢুকবে, তাঁর নাম ধরে ডেকে তাঁকে স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তুলবে। সে নিজেকে আশ্বস্ত করতে ফিসফিস করে বলল, “ডাক্তার বলেছে ও ভাল হয়ে যাবে-”

আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিলাম এই বলে, “হ্যাঁ অবশ্যই ভাল হয়ে উঠবে। তুমি এবার নিচে যাও মিসেস রপার। আমরা ওর দেখভাল করছি।”

সে বলল, “হ্যাঁ যাচ্ছি।” যাবার আগে সে তাঁকে আরেকবার ছুঁয়ে দেখল আর বলল, “ওর কি ঠাণ্ডা লাগছে না?!...... ওর কি ভয়ানক ঠাণ্ডা লাগছে না?!”

বার্নি থিয়েটার রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই আমরা দুজনে মিলে ট্রলিটা ঠেলে নোংরা থিয়েটারে ঢুকলাম। রেসিডেন্ট সারজিকাল অফিসার মিস্টার সিকার্ট স্টেরাইল ক্যাপ, মাস্ক আর গাউন পড়ে এক কোণে তৈরি হয়ে বসে আছেন। আমরা মিলে তাঁকে টেবিলে শোয়াতেই এনেস্থেটিক জ্যাককে রাবার মাস্ক পরিয়ে দিল। বলল, “শুধু সামান্য একটু গ্যাস দেব যাতে সে অপারেশন চলাকালীন সময়টুকু অচেতন থাকে। তাঁর কন্ডি শন খুব খারাপ!” মিস্টার সিকার্ট উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, “এর ইনট্রাভেনাসটা কাটতে হবে। এটা তো ওয়ার্ডেই করবার কথা ছিল নার্স!”

আমি মাস্কের ভেতর থেকে আউরে গেলাম, “জানিনা স্যার। আসলে ওখানে এতো গ্যাঞ্জাম-!”

সে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, “গ্যাঞ্জাম, গ্যাঞ্জাম, গ্যাঞ্জাম- সব সময় তো একই রকম। এর পাটা একটু বের কর নার্স। কাম অন! তাড়াতাড়ি কর।খোদাই মালুম একটা ভয়ঙ্কর এয়ার রেইডের পর তোমাদের কি গতি হবে!”সে রোগীর শিরা কাটার সময় নিজের মনে গজগজ করে চলল।

আমি স্লুইসে গিয়ে ঢুকলাম স্যালাইন বোতলের জন্যে স্ট্যান্ড খুঁজে নিয়ে আসতে। স্লুইসের মেঝেতে ব্যবহৃত তোয়ালে, গাউনের স্তুপ জমে আছে। সিঙ্ক আর ময়লার বিন উপচে পড়ছে ময়লা গজ আর ব্যান্ডেজে। দূর থেকে চোখে পড়ল আরেকটি অপারেশন থিয়েটারে সবাই অপারেশন নিয়ে ব্যস্ত। সেখান থেকে একজন নার্স এক বালতি ময়লা তোয়ালে এনে মেঝেতে উপুড় করে ঢালল। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম সে স্যালাইনের স্ট্যান্ড কোথায় জানে কি না?

সে উত্তর দিল, “আমার কাছে কিছু জানতে চেওনা! হয় আমি ইতিমধ্যে পাগল হয়ে গিয়েছি!নয়তো পাগল হওয়ার পথে!”

অবশেষে জ্যাক রপারের অপারেশন শেষ হল। স্যালাইন পেয়ে বেচারার পালস কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু গায়ের চামড়া মরা মানুষের মতোই এখনো। তার দুই হাত আর শরীরের রঙ এখন গাঢ় বেগুনী বর্ণ ধারণ করেছে কারণ তাঁরা তাঁকে জেনটিইয়ান ভায়োলেটের প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে তাঁর শরীরজুড়ে এক্রোবেটদের আঁটসাঁট পোশাকের মত চকচকে চামড়ার প্রলেপ লেগেছে।

ওয়ার্ডে ফিরে আমার আর তাঁর কাছে বসে থাকার উপায় ছিল না। বাইরে আর স্লুইসে এতো বেশি কাজ জমে ছিল যে সেসব কাজে লেগে পরতে হল। কিন্তু জ্যাকের উপর আমার এতোটাই অধিকার বোধ জন্মেছিল যে আমার একটি চোখ সব সময় ওর দিকে লক্ষ্য রাখছিল। এমনকি আমার চেয়েও বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কেউ ওকে স্পর্শ করুক এটা পর্যন্ত মানতে পারছিলাম না এই ভেবে যে পাছে তাঁরা কেউ জ্যাকের ক্ষতি না করে ফেলে।

স্লুইসে ঢুকে ধপ করে মেঝেতে বসে পরলাম। আমার পাশে রবিনও ধপ করে বসল। একস্তুপ ময়লা চাদরের উপর বসে আমরা চরম ক্লান্তিতে নিঃশেষিত বোধ করতে করতে কিছুক্ষন কেঁদে নিলাম। আবিস্কার করলাম আমার সারাটা শরীর জুড়ে ব্যাথা আর একটু পর পর শুধু হাই তুলছি। হাই তোলা কিছুতেই থামাতে পারছি না।

আমরা যখন আবার নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছি, সিস্টার স্লুইসে ঢুকে আমাদের উদ্দেশ্যে বলল, “তোমরা এবার এগুলো বাথরুমে ডাম্প করে গোসলে চলে যাও। সকাল ছয়টায় ব্রেকফাস্টএর পর তোমাদের আবার একটু ওয়ার্ডে আসতে হবে। কিন্তু কথা দিচ্ছি শিফট চলাকালীন দিনের বেলায় তোমরা হোস্টেলে ফিরে একটু ঘুমিয়ে নিতে পার।”

ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমাদের জন্যে ছিল পরিজ, সসেজ আর বেকন। আর ছিল যতখুশি চাও কফি। ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আমাদের সাথে দেখা হল অল্প কিছু ডে নার্সদের সাথে যারা কিনা সারারাত ঘুমিয়ে, যাচ্ছে ব্রেকফাস্ট করতে। তাঁদেরকে রীতিমত এলিয়েন বোধ হল আর তাঁদের কিউরোসিটির জবাবে মুখ দিয়ে কিছু বের হতে চাইল না।

আমি ততোক্ষণে ক্লান্তির অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছি। আবার ওয়ার্ডে গিয়ে এমনভাবে বেড মেকিং, সবকিছু গোছগাছ করা এমন ভঙ্গিতে চালিয়ে যেতে লাগলাম যেন এটি অন্য সব দিনের মতোই স্বাভাবিক একটি দিন। যেন আর কোনদিন না ঘুমাতে পারলেও আমার কিছু যায় আসে না। শুধু আমার পাদুটিকে আর নিজের পা বলে বোধ হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল আলগা পা লাগিয়ে হাঁটছি। ওয়ার্ডের কিছু পুরুষ কর্মচারী যারা সারারাত ঘুমায়নি তাঁরাও মনপ্রান ঢেলে শ্রম দিচ্ছিল।আমাদের অনেক কাজই তাঁরা করে দিল। তাঁরা বেলকনি ঝাঁট দিয়ে দিল, অ্যাশট্রে গুলি খালি করল, রোগীদের ডাকে সাড়া দিল।আর যা যা সম্ভব হল তাঁরা করে দিল। বেগুনী শরীরগুলির দিকে তাঁরা নিরব সমবেদনার চোখ নিয়ে তাকাল। তাঁদের মাঝে মোটে ছয়জন বেঁচে আছে। শীঘ্রই সংখ্যাটি পাঁচে গিয়ে দাঁড়াবে। যেসব রোগীদের মুখমণ্ডল পুড়েছে তাঁদের মুখগুলি নিগ্রোদের মত কালো হয়ে গেছে আর চোখের পর্দা কেমন সাদা হয়ে আছে।

সিস্টার আমাকে বারোটায় ছুটি দিল। জ্যাক রপার ততক্ষণে জেগে উঠেছে। নিজে নিজে হাত দিয়ে ধরতেও পারে। আমার কাছ থেকে চায়ের কাপটি নিয়ে আমাকে “হ্যালো” বলল। আমার সাহস হল না সিস্টারকে জিজ্ঞেস করি জ্যাকের অবস্থা এখন কেমন? মনে ভয় হল পাছে সিস্টার বিপরীত কিছু বলে।

হোস্টেলে ফিরে বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ চোখে ঘুম এলো না। যখন ঘুমালাম আমি জ্যাককে স্বপ্ন দেখলাম। সন্ধ্যায় আবার ওয়ার্ডে ফিরে গেলাম। মনে হচ্ছিল আমি নিজে বুঝি চলছি না পাপেটের মত কেউ আমাকে সুতো দিয়ে চালাচ্ছে। সিস্টার তখনো ওয়ার্ডে আছে। কেউ তাঁকে ঘুমাতে দেখেনি।

ওয়ার্ডের আর সবার তুলনায় রপারের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ ছিল তাই সে পরিণত হল সিস্টারের সবচেয়ে প্রিয় রোগীটিতে। সে এমনভাবে জ্যাকের যত্ন নিল ঠিক যেমনটি একজন মা করে তাঁর সন্তানের জন্যে। সিস্টার যখন দেখতে পেল আমারও অস্বাভাবিক মায়া পড়েছে জ্যাকের উপর সে আমাকে অনেকটাই ছেড়ে দিল তাঁর কাজ। জানিনা কেন যেন সকালে ওয়ার্ডে যাওয়ার আগে ভীষণ ভয়ে থাকতাম কোন দুঃসংবাদ না শুনি! জ্যাকের বেঁচে থাকাটা এতোই গুরুত্ব বহন করতো আমার কাছে যে তাঁর উপর কেমন এক অধিকার বোধ জন্মে গিয়েছিল। অন্য রোগীদের আর যাকিছু ঘটুক কিন্তু জ্যাকের যেন কিছু না হয় এই ছিল আমার ভাবনা। জ্যাকের প্রতি আমার এই ভালবাসা নিয়ে আমি যেন পৃথিবীর সব অশুভকে হঠাতে চাইছিলাম যা পৃথিবীর সব তরুণ প্রাণকে থামিয়ে দিতে চায়।

মিসেস রপার প্রতিদিন আসত। জ্যাক খুব স্ফূর্তিবাজ ছেলে। যেখানে যেমন খাটত তেমন ছোটখাটো রসিকতা করে পরিবেশ আনন্দমুখর করে রাখত। আর কেউ তাঁকে একটু হাসাতে চাইলে খুব নরম হাসিতে তাঁর সাথে যোগ দিত।

শুক্রবার সন্ধ্যায় সিস্টারের উইক এন্ড অফের সময়। নার্স সাওয়ারবি আগে থাকতেই টের পেয়েছে যে তাঁকে ইন চার্জের দায়িত্ব পালন করতে হবে সিস্টারের অবর্তমানে। সে আমাকে বাথরুমে তাঁর ভেরিকোস ভেইন দেখাচ্ছে আর বলছে, “আমার পায়ের মত দুর্বল পা হলে তুমি না জানি কি করতে?!” সে গুঙিয়ে উঠে বলল, “দুর্বল কিনা বল?!”

আমি স্বীকার করে বললাম, “বেশ দুর্বল”

সে বলল, “এরা আরও দুর্বল হয়ে যায় সিস্টার যখন ছুটিতে থাকে। ওহ ডিয়ার! এই ছুটির দিনটি অন্য ছুটির দিনগুলির চেয়েও ভয়াবহ কাটবে আমার মনে হয়! গতবার স্টেরিলাইজারের পাম্প বার্স্ট হল। তার আগের বারো এরকম একটা কিছু হল!” বেচারি স’র দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু তো নয়!

যাইহোক এই উইক এন্ড মোটামুটি মন্দ যাচ্ছিল না, সিস্টার শুক্রবার বিকেলে সন্তুষ্ট চিত্তে বিদায় নিলেন। ওয়ার্ডটিও অনেক রোগীতে ভরপুর ছিল না। বার্ন কেসগুলিও ভালোই সেরে উঠছিল। স্যার কার্টিস রাওনট্রি অপারেশন শেষ করে রাউণ্ডে এলেন। জ্যাক রপারের অবস্থা দেখে উনাকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হল। স’এর চেহারা মাত্রাতিরক্ত উজ্জ্বল দেখাল।

কিন্তু শনিবার সকাল শুরু হল বিশ্রীভাবে। আমি এক রোগীর বেড তৈরি করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তাঁর পেটের নলটি বের করে ফেললাম। নার্স রছ ডাক্তার রাউন্ডে আসার আগে এক ঘণ্টার উপর কসরত করতে থাকল নলটিকে পুনরায় আগের মত স্থাপন করতে। নার্স সাওয়ারবি রেগে গিয়ে স্বগক্তি করতে থাকল, “এই অসাবধানতার হেতু সারাদিনের রুটিনই বরবাদ হয়ে গেল” এসব বলে। সে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “নার্স রছ আরও এক ঘণ্টা আগেই ড্রেসিং শুরু করতে পারত। এখন ডিনারের আগে কিছুতেই সবগুলি ড্রেসিং শেষ করা যাবে না! আমিই বরং ড্রেসিং এর কাজ শুরু করে দেই। কিন্তু ডাক্তার রাউন্ডে চলে এলে তখন কি হবে?! তুমি কেমন করে এতোটা অসাবধান হতে পারলে নার্স ডিকেন্স?!”

আমি জবাব দিলাম, “আমি কি ইচ্ছে করে করেছি?!”

স ভীষণ রেগে গিয়ে আমাকে বলল, “তুমি যদি আবার ওই স্বরে আমার সাথে কথা বল তবে তোমাকে আমি সোজা মেট্রনের কাছে পাঠাবো!”

আমি মরিয়া হয়ে বলে উঠলাম, “কিন্তু স -”

স এবার নিজের উপর বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, “ঠিক আছে সোনা মন খারাপ করো না। আমি বরং মারা যেতে রাজি আছি তবু কাউকে ঝামেলায় ফেলতে পারব না! মাঝে মাঝে এতোই উদ্বিগ্ন হয়ে যাই যে কি বলছি তা খেয়াল থাকে না!”

তারপর সে পর্দার এপাশ থেকে রছের কাছে জানতে চাইলো কাজটি সে করতে পেরেছে কি না?!

রছ রেগেমেগে জবাব দিল, “মনে হচ্ছে কাজটা এমনি ফেলে রাখি যাতে ডাক্তার রাউন্ডে এসে দেখে এটা!”

তখন স বলল, “দয়া করে তেমন কিছু কোরো না! জানি না ডাক্তার মরিস ইভান্স রাউন্ডে এলে কি বলবেন?!আমি বরং ড্রেসিং এর কাজ খানিকটা এগিয়ে রাখি।”

আমাকে ট্রলি আনতে পাঠিয়ে নার্স স মাত্রই প্রথম রোগীটির ব্যান্ডেজ খুলেছে এমন সময় একজন মোটা সোটা রাগী চেহারার সার্জেন্টের সাথে পাতলা মতন হাউজ সার্জেন্টের প্রবেশ। রাগী সার্জেন্টটি এসেই প্রথমে সিস্টারকে তলব করলেন। নার্স হাওয়েস তাঁর এপ্রন ঠিক করতে করতে নম্র স্বরে জবাব দিল সিস্টার ছুটিতে আছে। সে তখন রাগত ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, “স্টাফ নার্স কোথায়?!”

গর্জন শুনে স দৌড়ে এলো। তাঁর দুহাত রক্তে মাখামাখি হাত থেকে রক্তের ফোঁটা পরল মেঝেতে। বেচারি স যখনই ড্রেসিং শুরু করে তখনি তাঁর ডাক পরে। যখন রোগীদের লাঞ্চের সময় হল তখনো সে বলে চলেছে ড্রেসিং শুরু করার কথা। নার্স রছ তখন লাঞ্চে যাবার মুহূর্তে শুনিয়ে বলল, “আমি সবগুলি ড্রেসিংই শেষ করে ফেলেছি।”আমি তাঁকে বললাম, “বাঁচালে! কি করে করলে এতো তাড়াতাড়ি?!”

সে বিশ্রীভাবে জবাব দিল, “মেথড!!”

রবিবার সন্ধ্যায় নার্স সাওয়ারবির জন্যে এক কাপ আর নিজের জন্যে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে সিস্টারদের ওয়েটিং রুমে দুজনে বসলাম। বললাম, “উইক এন্ড প্রায় শেষ হয়ে এলো, থ্যাঙ্ক গুডনেস যে আমরা ভালমতোই উৎরেছি।” সে আর্ম চেয়ারে ডুবে যেতে যেতে পায়ের জুতা জোড়া খুলে ফেলতে ফেলতে উত্তর দিল, “আগামীকাল সিস্টার ওয়ার্ডে এসে মনে হয় না কোন ভুল বের করতে পারবে! রাতের ঘুমটা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব আশা করছি। তুমি কি দারুন চা বানাও ডিয়ার! হোস্টেলে ফেরার আগে ওয়ার্ডে একবার উঁকি দিয়ে যেও। ঐ এপেনডিক্সের রোগীটার অবস্থা খুব একটা সুবিধার লাগছে না।”

আমি হোস্টেলে ফেরার আগে ওয়ার্ডে গিয়ে রোগীটিকে দেখলাম। মনে হল উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। জ্যাক রপারকে গুড নাইট বললাম। তারপর হোস্টেলে ফিরে এলাম।

সাওয়ারবি সেদিন হয়তো ভালোই ঘুমিয়েছে। কিন্তু আমারই কেন যেন ঘুম আসতে চাইলো না। একটা বই নিয়ে ঘণ্টা খানেক পড়লাম তারপর আধো ঘুমে আধো জাগরণে টুকরো টুকরো স্বপ্ন দেখে চললাম। একবার ঘুম ভেঙ্গে গেল প্রচণ্ড ভয়ে, দেখি হৃৎপিণ্ড ধকধক করছে দ্রুতলয়ে। নিজের রুমকে ভূতুরে লাগছিল ভীষণ। শেষমেশ বিছানা থেকে নেমে দরজাটা ভাল করে লাগিয়ে বিছানায় ফিরে গেলাম। আবার টুকরো টুকরো দুঃস্বপ্ন হানা দিল। জেগে দেখি কেউ আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে। ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলাম। সাদা অবয়বটি তখন কথা বলে উঠল, “ভয় পেয়ো না। আমি নার্স এন্ডরু”। এন্ডরু আমার ওয়ার্ডের নাইট নার্স। আমি বললাম, “কি হয়েছে? সকাল হয়ে গেছে এতো তাড়াতাড়ি!”

সে বলল, “কন্টিনিউয়াস ন্যাজাল অক্সিজেন এপারেচাসটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি গতকাল তোমাকে পরিস্কার করতে দেখেছিলাম”

আমি তাঁকে বললাম কোথায় রেখেছি সেটা, বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভুল জায়গায় রেখেছি জিনিসটা । জিজ্ঞেস করলাম, “কার জন্যে প্রয়োজন ওটা?”

সে উত্তর দিল, “রপার কোলাপ্স করেছে।”

 

মনিকা ডিকেন্সের আত্মজীবনী: এক জোড়া পা (প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়)

মনিকা ডিকেন্সের আত্মজীবনী: এক জোড়া পা (তৃতীয় অধ্যায়)

 

নিউজবাংলাদেশ.কম/টিএবি

নিউজবাংলাদেশ.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়