News Bangladesh

নিউজ ডেস্ক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:১১, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শুভ মহালয়া: শুরু হলো দুর্গাপূজার ক্ষণগণনা

শুভ মহালয়া: শুরু হলো দুর্গাপূজার ক্ষণগণনা

ফাইল ছবি

সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গোৎসব। দেবীপক্ষের প্রথম দিন হিসেবে মহালয়ায় শ্রীশ্রী চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে মর্ত্যলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। 

রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর) ভোরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন মন্দিরে দেবীর আরাধনা, চণ্ডীপাঠ এবং তর্পণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হয় মহালয়া।

হিন্দু বিশ্বাস মতে, মহালয়া থেকেই দেব-দেবীকুল দুর্গাপূজার জন্য জাগ্রত হন। ভক্তরা গঙ্গাতীরে ও মন্দির প্রাঙ্গণে তর্পণের মাধ্যমে মৃত আত্মীয়-স্বজন ও পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনা হয় এই দিনে।

পুরাণে মহালয়ার তাৎপর্য

পুরাণ মতে, মহালয়ার দিনে দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব লাভ করেন। শিবের বর অনুযায়ী, কোনও মানুষ বা দেবতা মহিষাসুরকে বধ করতে পারতেন না। ফলে অসীম ক্ষমতাশালী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দখল করতে উদ্যত হন। তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব সম্মিলিতভাবে মহামায়া রূপে নারীশক্তি সৃষ্টি করেন। দেবতাদের দশটি অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে সিংহবাহিনী নিয়ে দেবী দুর্গা নয় দিনব্যাপী যুদ্ধে মহিষাসুরকে বধ করেন। এই ইতিহাসের স্মারক হিসেবে মহালয়া পালিত হয় এবং চণ্ডীপাঠে দেবীর প্রশস্তি উচ্চারিত হয়।

শরতের প্রভাতে চণ্ডীপাঠ, ঢাক-কাঁসর, শঙ্খধ্বনি ও ঘট স্থাপনের মধ্য দিয়ে দেবীকে আহ্বান জানানো হয়। অনেক ভক্ত তর্পণ করে প্রয়াত আত্মার শান্তি কামনা করেন।

দুর্গোৎসবের দিনক্ষণ

আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর মহাসপ্তমী, ৩০ সেপ্টেম্বর মহাষ্টমী ও কুমারীপূজা, ১ অক্টোবর মহানবমী এবং ২ অক্টোবর বিজয়া দশমী ও প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাঁচ দিনের দুর্গোৎসব।

রমনা কালীমন্দিরের পুরোহিত হরিচাঁদ চক্রবর্তী জানান, ভোর সাড়ে ৫টায় মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবীর মর্ত্যে আগমন ঘটবে। ২৮ সেপ্টেম্বর মহাষষ্ঠী, ২৯ সেপ্টেম্বর মহাসপ্তমী, ৩০ সেপ্টেম্বর মহাষ্টমী ও পয়লা অক্টোবর মহানবমী পূজা হবে। ২ অক্টোবর বিজয়া দশমীর পূজা শেষে মা দুর্গা আবার কৈলাসে ফিরে যাবেন।

দেবীর আগমন ও গমন

সনাতন পঞ্জিকা অনুযায়ী, এ বছর দেবী দুর্গা হাতিতে চড়ে মর্ত্যলোকে আগমন করবেন, যা শস্যপূর্ণ বসুন্ধরার বার্তা বহন করে। তবে দেবীর গমন হবে পালকিতে, যা অশুভ লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়, যার অর্থ রোগবালাই ও দুর্যোগের আশঙ্কা বৃদ্ধি।

ঢাকেশ্বরী দুর্গাপূজা মণ্ডপের পুরোহিত বরুণ চক্রবর্তী বলেন, মহালয়ার মাধ্যমে দুর্গোৎসবের ক্ষণগণনা শুরু হয়। মহালয়ায় ঘট বসানো হয়। ঘট বসানোর মাধ্যমে দেবী কৈলাস থেকে মর্ত্যে আগমন করেন।

আরও পড়ুন: আগামী ২১ সেপ্টেম্বর মহালয়া, দুর্গাপূজার প্রস্তুতি শুরু

পূজামণ্ডপ ও প্রস্তুতি

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারাদেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে, যা গত বছরের তুলনায় ১ হাজার ১১৯টি বেশি। রাজধানীতে পূজামণ্ডপের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫৮টি, গতবার ছিল ২৫২–২৫৩টি।

ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, বনানী মাঠ, রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ, রাজারবাগ কালীমন্দির, রমনা কালীমন্দির, সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, জগন্নাথ হল, স্বামীবাগ লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম, রামসীতা মন্দির, জয়কালী মন্দিরসহ রাজধানীর বিভিন্ন মন্দির ও পূজামণ্ডপে মহালয়ার দিনে চণ্ডীপাঠ, বিশেষ পূজা, ভক্তিমূলক সংগীত, ধর্মীয় আলোচনা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

রমনা কালীমন্দিরের শিল্পী রতন পাল জানান, প্রতিমা তৈরির কাজ প্রায় শেষ। এখন রঙের কাজ শুরু হবে। এরপর প্যান্ডেলের সাজসজ্জা হবে। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরেও প্রতিমার মাটির কাজ শেষ হয়েছে, চলছে রঙ ও সাজসজ্জার কাজ।

নিরাপত্তা ও সরকারি সহায়তা

দুর্গোৎসবকে ঘিরে প্রশাসন তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে প্রাক-পূজা, পূজাকালীন ও বিসর্জন পরবর্তী সময়ের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।

তবে নাগরিক সমাজভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ‘সম্প্রীতি যাত্রা’ ২৯টি জেলাকে পূজাকে কেন্দ্র করে ঝুঁকিপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ঢাকা, রংপুর, যশোর, চাঁদপুর ও নোয়াখালীকে উচ্চঝুঁকিতে বলা হয়েছে। 
সংগঠক ও গবেষক মীর হুযাইফা আল-মামদূহ জানান, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পরও পূজার নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর বলেন, প্রতিমা তৈরি ও সাজসজ্জার পাশাপাশি পূজার নিরাপত্তা নিয়েও কাজ চলছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দুর্গাপূজার জন্য এ বছর ৫ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। 
হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান তপন চন্দ্র মজুমদার জানান, প্রতিটি মণ্ডপে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। তবে যেসব মন্দিরের নামে ব্যাংক হিসাব নেই, সেখানে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

সর্বজনীন উৎসবের আবহ

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় এই উৎসবকে ঘিরে সারাদেশে চলছে প্রতিমা নির্মাণ, সাজসজ্জা, প্যান্ডেল তৈরিসহ ব্যাপক প্রস্তুতি। রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির উদ্যোগে কেন্দ্রীয় পূজা মণ্ডপে মহালয়ার চণ্ডীপাঠ ও বিশেষ পূজার আয়োজন হয়।

ভক্তদের বিশ্বাস, শরতের আকাশ-বাতাসে এখনই ধ্বনিত হচ্ছে দেবী বন্দনার আহ্বান—“রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশো দেহি, দ্বিষোজহি।” মহালয়ার ভোর থেকেই শারদীয় দুর্গোৎসবের ক্ষণগণনা শুরু হলো।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়