News Bangladesh

নিউজ ডেস্ক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৪:৪৮, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

৩ দিন ধরে মৃত সন্তানের পাশে শোকাহত মা হাতি

৩ দিন ধরে মৃত সন্তানের পাশে শোকাহত মা হাতি

ছবি: সংগৃহীত

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটির বরকল উপজেলার বরুনাছড়ি গ্রামে বিরল প্রজাতির একটি গোলাপি হাতি শাবকের মৃত্যু হয়েছে। 

সোমবার (২০ অক্টোবর) রাতে খাড়া পাহাড় থেকে পা পিঁছলে হ্রদের পানিতে পড়ে শাবকটি আহত হয়ে ডুবে যায় বলে ধারণা বন বিভাগের। 

শাবকটির মৃত্যুর পর টানা তিন দিন ধরে তার নিথর দেহের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে মা হাতি—মুহূর্তের জন্যও জায়গা ছাড়েনি সে। হৃদয়বিদারক এই দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছে বরুণাছড়ি গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দারা।

স্থানীয়রা বলছেন, মা হাতিটির চোখে-মুখে বিষণ্ণতা আর অস্থিরতা স্পষ্ট। মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই ক্রোধান্বিত হয়ে তেড়ে আসে সে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের কাচালংমুখ বনশুল্ক ও পরীক্ষণ ফাঁড়ির আওতাধীন লিটনের টিলায় খাড়া পাহাড় থেকে পা পিছলে কাপ্তাই হ্রদের পানিতে পড়ে যায় হাতি শাবকটি। আহত অবস্থায় পানিতে ডুবে যায় এবং পরে মৃত অবস্থায় ভেসে ওঠে। 

বন বিভাগ জানিয়েছে, শাবকটির বয়স আনুমানিক ৮-১০ মাস।

স্থানীয়দের মতে, মৃত হাতিটি সম্প্রতি ‘গোলাপি হাতি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। চলতি বছরের জুন মাসে বরকল উপজেলার বরুনাছড়িতে প্রথমবারের মতো দেখা যায় এই বিরল রঙের হাতি শাবকটিকে। দক্ষিণ এশিয়ায় এটি ছিল প্রথম গোলাপি হাতির জন্ম। সে সময় কাপ্তাই হ্রদ সাঁতরে পার হওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। 

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছিলেন, হরমোনজনিত বা জিনগত অস্বাভাবিকতার কারণে হাতির গায়ের রঙে এমন ভিন্নতা দেখা যেতে পারে।

আরও পড়ুন: টেকনাফে মানবপাচার চক্রের আস্তানায় বিজিবির অভিযান, ৬ জিম্মি উদ্ধার

মৃত শাবকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মা হাতিটি মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই তেড়ে আসছিল। ফলে মঙ্গলবার ও বুধবার দুই দিন ধরে বন বিভাগ মৃতদেহ উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চিকিৎসক দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও শাবকের দেহে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বুধবার মৃতদেহের অবস্থান স্থানান্তর হওয়ায় মা হাতির অবস্থানও পরিবর্তিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রফিকুজ্জামান শাহ বলেন, হাতি শাবক মৃত্যুর ঘটনায় জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ও ভেটেরিনারি সার্জনকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বুধবার আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, মৃত হাতির বাচ্চাটি যেখানে ছিল, সেখান থেকে সরিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। মা হাতিটি ৮-১০ ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু মা হাতিটি সেখানে অবস্থান করছে, আমরা কাছাকাছি যেতে পারিনি। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার টিম নিশ্চিত করেছেন যে শাবকটি পড়ে গিয়েই হ্রদের পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেছে। মৃতদেহের কাছে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় পোস্টমর্টেম করা যায়নি। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে এবং নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে—যতক্ষণ হাতির পাল সেখানে অবস্থান করছে, ততক্ষণ যেন কেউ সেখানে না যায়। পাল সরে গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

উত্তর বন বিভাগের সুবলং রেঞ্জের কর্মকর্তা মতিউর রহমান বলেন, মা হাতির সামনে থেকে শাবকটি উদ্ধার করা সম্ভব নয়। কারণ, সেটা করতে গেলে মা হাতি পাগল হয়ে পুরো গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে। তাই আমরা অপেক্ষা করছি। মা হাতিটি সরে গেলে শাবকের দেহ উদ্ধার করে মাটিচাপা দেওয়া হবে।

হাতি সুরক্ষা দলের সদস্য মো. লিটন হোসেন জানান, কাপ্তাই হ্রদে ভাসছিল গোলাপি হাতির মৃতদেহ। তা দেখে পানিতে লাফিয়ে পড়ে মা হাতিটি। শুঁড় দিয়ে কোনোরকমে হ্রদের পারে টেনে আনে প্রিয় শাবকের দেহটি। কিন্তু পানি থেকে ওপরে তোলার সাধ্য তার নেই। তাই হ্রদের পারে দাঁড়িয়ে থেকে সন্তানের মৃতদেহ পাহারা দিচ্ছে মা। তিন দিন ধরে মুহূর্তের জন্যও সরেনি হাতিটি।

বন বিভাগের তথ্যমতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন কাপ্তাই ও রাজস্থলী উপজেলা এবং উত্তর বন বিভাগের আওতাধীন বরকল ও লংগদু উপজেলায় বিভিন্ন সময়ে ২৪-২৬টি হাতির বুনো পাল দেখা যায়। এই পালের মধ্যেই ছিল গোলাপি হাতি শাবকটি।

এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তবে শাবকের মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটনে এখনও পোস্টমর্টেম সম্ভব হয়নি। 

বন বিভাগ জানিয়েছে, হাতির পাল সরে গেলে মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করা হবে।

এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে, প্রাণীরাও অনুভূতি প্রকাশে সক্ষম। মা হাতির নিঃশব্দ আর্তনাদ যেন বোবা ভাষায় বলে যাচ্ছে—“যার চলে যায় সেই বুঝে হায় বিচ্ছেদ কী যন্ত্রণা।”

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়