News Bangladesh

নিউজ ডেস্ক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৬:৪৯, ২০ আগস্ট ২০২৫

ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের ভাবনা

ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের ভাবনা

ফাইল ছবি

দেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে। প্রথমবারের মতো গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও খেলাপি ঋণের ঝুঁকিতে থাকা পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন ও শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য হলো এই ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করা এবং দেশের আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। সরকার সবুজ সংকেত দিলে এই একীভূতকরণের চূড়ান্ত রূপরেখা বাস্তবায়ন করা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক চিহ্নিত করা পাঁচটি ব্যাংক হলো এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক।

এই পাঁচটি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা বর্তমানে অত্যন্ত নাজুক। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের প্রায় ৭৭ শতাংশ বা প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৬ শতাংশ, এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ ঋণই খেলাপি, যা চরম ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এই একীভূতকরণের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া রূপরেখা তৈরি করেছে, যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন ব্যাংকটি প্রাথমিকভাবে সরকারি মালিকানায় পরিচালিত হবে এবং এর তত্ত্বাবধানে থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিন থেকে পাঁচ বছর পর এটি বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হবে। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থা বা ভালো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

নতুন ব্যাংকের প্রস্তাবিত নাম নিয়ে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ ও ‘আল ফাতাহ ইসলামী ব্যাংক’—এই দুটি নাম আলোচনায় রয়েছে। আগামী অক্টোবরের মধ্যেই নাম চূড়ান্ত করা হতে পারে। নতুন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় হিসেবে প্রাথমিকভাবে মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনকে নির্বাচন করা হয়েছে।

পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করতে প্রাথমিক ব্যয় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ সংস্থানের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহের পরিকল্পনা করা হয়েছে:

  • সরকারি মূলধন: সরকার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন হিসেবে চাওয়া হবে। ইতোমধ্যে সরকার এই কাজের জন্য বাজেটে ৳১৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে।
  • আমানত বীমা তহবিল: আমানত বীমা তহবিল থেকে প্রায় ৳৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে, এই তহবিলের বর্তমান আইন অনুযায়ী, এই অর্থ শুধুমাত্র সরকারি ট্রেজারি বিল বা বন্ডে বিনিয়োগ করা যায়। তাই অর্থ সংস্থানের জন্য এই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
  • আন্তর্জাতিক ঋণ: বাকি অর্থ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এবং এডিবি-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া হবে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করার প্রস্তুতি চলছে।

আরও পড়ুন: ৭-৮ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ক্যাশলেস ইকোনমির বড় কেন্দ্র হবে: গভর্নর

বাংলাদেশ ব্যাংক এই একীভূতকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে আমানতকারী ও কর্মীদের স্বার্থ সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে।

  • ক্ষুদ্র আমানতকারী: ক্ষুদ্র আমানতকারীদের আমানত সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকবে এবং তা নতুন ব্যাংকের আমানত হিসেবে জমা হবে।
  • প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী: প্রাতিষ্ঠানিক আমানতগুলো শেয়ারে রূপান্তরিত করা হবে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা চাইলে তাদের শেয়ার বিক্রি করে অর্থ তুলে নিতে পারবেন।
  • কর্মী: কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে যে গণহারে কর্মী ছাঁটাই করা হবে না। বিশেষ করে যারা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়েছেন এবং অনিয়মে জড়িত নন, তাদের চাকরি সুরক্ষিত থাকবে। তবে একই এলাকায় একাধিক শাখা থাকায় কিছু কর্মীকে অন্যত্র সমন্বয় করা হতে পারে। নতুন ব্যাংককে গ্রামীণ এলাকায় প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে, যা কর্মী ছাঁটাইয়ের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হবে।

এই একীভূতকরণের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রায় ৳৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকার নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি মোকাবিলা করা এবং নতুন ব্যাংককে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।

তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশাবাদী যে এই উদ্যোগ সফল হলে দেশের ব্যাংকিং খাত আরও স্থিতিশীল ও শক্তিশালী হবে। নতুন ব্যাংকটিকে একটি বৃহৎ এসএমই ব্যাংক হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা দেবে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমানত সংগ্রহ করে সেখানেই বিনিয়োগ করবে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন যে, বাংলাদেশে এ ধরনের লুটপাটের কারণে ব্যাংক একীভূতকরণের ঘটনা বিরল এবং এটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট থেকে ভিন্ন। তিনি সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য দক্ষ নেতৃত্ব এবং কর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণের ওপর জোর দিয়েছেন।

এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হলে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্বলতাগুলো দূর হবে এবং আমানতকারীদের আস্থা ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই পদক্ষেপটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের আর্থিক খাতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়