News Bangladesh

আন্তর্জাতিক ডেস্ক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৩:২০, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এবার দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে ফুঁসছে ফিলিপাইন

এবার দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে ফুঁসছে ফিলিপাইন

ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে জনরোষ বিস্ফোরিত হয়েছে। টিকটক, ফেসবুক ও এক্সসহ সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ উগরে দেওয়া সাধারণ মানুষ এবার রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী ২১ সেপ্টেম্বর দুর্নীতিবিরোধী এক বিশাল বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে। দিনটি আবার ১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস সিনিয়রের সামরিক আইন জারির বার্ষিকী। উল্লেখ্য, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনই ১৯৮৬ সালে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়।

সাম্প্রতিক অস্বাভাবিক মৌসুমি বৃষ্টিপাতে রাজধানী ম্যানিলাসহ বিভিন্ন শহর নদীতে পরিণত হয়েছে। রাস্তায় গাড়ি ভেসে গেছে, লাখ লাখ মানুষ যাত্রাপথে আটকে পড়েছে। ইঁদুরবাহিত রোগ লেপ্টোস্পাইরোসিস ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

৩৬ বছর বয়সী স্কুলশিক্ষিকা ক্রিসা টোলেন্তিনো প্রতিদিনই নৌকায় করে প্লাবিত রাস্তায় চলাচল করেন। তিনি কাজে যান, এমনকি ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য ক্লিনিকেও পৌঁছান এভাবেই। 

তার অভিযোগ, আমি কঠোর পরিশ্রম করি, অল্প খরচ করি, প্রতি মাসে বেতনের টাকা থেকে কর কেটে নেওয়া হয়। তারপর শুনতে হয়, সেই টাকা দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা ভোগ করছেন। আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।

এই অভিযোগ এখন ফিলিপাইনজুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। জনগণের প্রশ্ন—কোটি কোটি টাকার সড়ক, সেতু, বাঁধ নির্মাণে খরচ হলেও বন্যা নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ কেন?

ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ “বংবং” মার্কোস জুনিয়র নিজেই একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন, প্রকল্পটি আদৌ নেই। পরে অর্থনৈতিক পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, বরাদ্দ করা সরকারি অর্থের ৭০ শতাংশ দুর্নীতিতে লোপাট হয়েছে।

প্রকাশ্যে আসা তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ১৫টি কোম্পানি ৫৪৫ বিলিয়ন পেসো (৯ বিলিয়ন ডলার) মূল্যের বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প পেয়েছিল। বর্তমানে এসব কোম্পানির সম্পদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফ্রিজ করেছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে ব্যবসায়ী দম্পতি প্যাসিফিকো ও সারা ডিসকায়া। সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসলেও তারা বর্তমানে বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য পরিচিত। তাদের কোম্পানিকে সরকারি টেন্ডারে সুবিধা দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। তদন্তে দেখা গেছে, তারা সংসদ সদস্যদের ঘুষ দিয়েছেন। 

এক শুনানিতে প্যাসিফিকো স্বীকার করেছেন, আমরা কিছুই করতে পারিনি, বাধ্য হয়ে আইনপ্রণেতাদের টাকা দিতে হয়েছে।

তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কোম্পানিটি কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে। অফিসের গেটে কাদা মাখানো ও “চোর” লিখে স্প্রে করা হয়েছে।

এই কেলেঙ্কারিতে হাউস স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, যদিও তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অপরদিকে, সিনেটের প্রধানকেও পদচ্যুত করা হয়েছে। কারণ, একটি সরকারি টেন্ডার পাওয়া ঠিকাদার তার নির্বাচনী প্রচারে বেআইনিভাবে অর্থ দিয়েছিলেন।

রাজনীতিবিদ ও ঠিকাদার পরিবারের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়েও ক্ষোভ বেড়েছে। সামাজিক মাধ্যমে তাদের ‘নেপো বেবিস’ বলে কটাক্ষ করা হচ্ছে। অনেকে দামি পোশাক, গাড়ি ও বিদেশ ভ্রমণের ছবি পোস্ট করে সমালোচনার মুখে পড়েছেন।

আরও পড়ুন: গাজায় একদিনে নিহত ৯৮, প্রাণহানি ছাড়াল ৬৫ হাজার

এক সাবেক সংসদ সদস্যের মেয়েকে সমালোচনা করা হয়েছে শুধু একটি পোশাকের জন্য—যেখানে তিনি ফেন্ডি, ডিওর ও হারমেস বারকিন ব্যাগ একসঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন। এর পর অনেকেই তাদের অ্যাকাউন্টের মন্তব্য বন্ধ করেছেন বা একেবারেই নিষ্ক্রিয় করেছেন।

ক্ষুব্ধ জনগণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে রাজনীতিবিদদের কুমির রূপে ভিডিও বানাচ্ছেন—যা লোভ ও দুর্নীতির প্রতীক। ২০০৯ সালের জনপ্রিয় র‍্যাপ গান “উপুয়ান” (Gloc-9) আবারও প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে, যার মূল বার্তা—রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষের কষ্ট বোঝেন না।

একটি অনলাইন সংগঠন ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সৃষ্টিশীলরা’ ঘোষণা দিয়েছে: আমরা নিরলস হবো, উচ্চকণ্ঠ হবো, ক্ষমতার সামনে আয়না ধরবো, ন্যায়বিচার না আসা পর্যন্ত থামবো না।

এদিকে সড়কে দুর্নীতি বিরোধী শ্লোগান দিতে গিয়ে জনগণ সরকারি প্রকৌশল দপ্তরের কর্মীদের হয়রানি করছে, ফলে তারা আর অফিসিয়াল ইউনিফর্ম পরছেন না।

মার্কোস জুনিয়র সাংবাদিকদের বলেছেন, আমি যদি প্রেসিডেন্ট না হতাম, তবে হয়তো আমিও তাদের সঙ্গে রাস্তায় নামতাম। দুর্নীতিবাজরা কতটা ক্ষতি করেছে তা জানাও। চিৎকার করো, প্রতিবাদ করো, তবে শান্তিপূর্ণভাবে।

তিনি আরও জানান, দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কঠোর তদন্ত শুরু হয়েছে। “তোমরা নির্লজ্জ” বলে সরাসরি অভিযুক্তদের উদ্দেশে বার্তাও দিয়েছেন।

ফিলিপিনোরা দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে নতুন নয়। অতীতে দুর্নীতির কারণে দুই প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে। ২০১৩ সালে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ভুয়া প্রকল্প বানিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল।

সাবেক বিচারমন্ত্রী লেইলা দে লিমা, যিনি সে সময় তদন্ত করেছিলেন, সম্প্রতি এক পডকাস্টে বলেছেন, তখন বিলিয়ন টাকার দুর্নীতি হতো, এখন তা শত শত বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি ভীষণ ভয়াবহ।

অন্যদিকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনই ইন্দোনেশিয়ায় আইন সংস্কার এনেছে এবং নেপালে সরকার পতন ঘটিয়েছে। ফিলিপাইনে আসন্ন বিক্ষোভকে তাই গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘোরানোর মুহূর্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এ অবস্থায় মানুষ নানা উপায়ে বন্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। গবেষক রেন্স রাফায়েল গালাং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বিশেষ পোশাক বানিয়ে বিক্রি শুরু করেছেন—যেখানে ওভারঅলসের সঙ্গে বুট সেলাই করা আছে। তার ভিডিও লাখো মানুষ দেখেছে। 

তিনি বলেন, আমাদের এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের টাকাও দুর্নীতিতে নষ্ট হয়েছে। তবে আমি আশাবাদী, একদিন সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে।

ভয়াবহ বন্যা, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সরকারি অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি এখন ফিলিপাইনের জাতীয় সংকটে রূপ নিয়েছে। জনতার ক্ষোভ আর সামাজিক আন্দোলনের চাপে সরকার এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। ২১ সেপ্টেম্বরের বিক্ষোভ দেশটির রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় লিখতে পারে—যেমনটি ঘটেছিল ১৯৮৬ সালে।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়