মরে যাচ্ছে নদী: বুকে বোরো চাষ
পঞ্চগড়: পঞ্চগড়ে নদী মরে যাচ্ছে। মরা নদীর বুক ভরে উঠেছে ভূমিহীন চাষীদের ফলানো ধানে। মৃতপ্রায় এসব নদ-নদীতে জেগে ওঠা বালুচরের পতিত জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকরা। এতে নদী তীরের দরিদ্র কৃষকদের আপাত সচ্ছলতাও এসেছে।
জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট-বড় ২৫টি নদীর উৎসমুখ ভারতের উজানে একতরফাভবে বাঁধ নির্মাণ করার ফলে শুকনো মৌসুমে এসব নদ-নদীতে চর পড়ে যায়। আর এ সুযোগে নদী তীরবর্তী ভূমিহীনরা নদীর চরকেই চাষাবাদের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়।
শুকনো মৌসুমে প্রতিবছরের ন্যায় এ বছর জেলার ছোট-বড় নদীগুলোতে বোরো ধান চাষ করেছেন সহস্রাধিক কৃষক। বর্তমানে রোপন পরবর্তী পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। নদীতে ধানের সবুজ চারাগাছ বাতাসে দোল খাচ্ছে। নদী বক্ষের বিস্তৃর্ণ এলাকা ধান গাছের কাচা রঙে সবুজ হয়ে উঠেছে।
শুধু করতোয়া নদীতেই নয়, জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট-বড় প্রায় ২৫ টি নদীর চিত্র একই। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে বাঁধ নির্মাণের কারণে প্রতিবছর এই মৌসুমে পঞ্চগড়ের প্রতিটি নদীই পানি শূন্য হয়ে যায়। চুয়ে আসা সামান্য পানিতেই নদীর দুকূলের ভূমিহীনরা প্রতিবছরই চাষ করে আসছেন বোরো ধান।
ভূমিহীন বোরো চাষীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নিজস্ব জমি না থাকায় তারা চাষাবাদ করতে পারেন না। অপরদিকে সেচ দেওয়া পানির চেয়ে নদীর চুয়ে আসা পানি বোরো চাষে অনেক বেশি উপকারী। এতে সার ও সেচ সহ সবকিছুতেই সাশ্রয় হয় চাষীদের।
পঞ্চগড় জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চাওয়াই, মহানন্দা, ডাহুক, বেরং, টাঙ্গন, তালমা, পাঙ্গা, পাম, ভেরসা, আত্রাই, গোবরা, তীরনই, রণচনণ্ডী, ছেতনাই, পেটকি, ঘোরামারা, মরা তিস্তা, নাগর, খড়খড়িয়া, সুই, ছোট যমুনা, করতোয়া, পাথরাজ, ভূল্লি, কুড়ুম সহ প্রায় প্রতিটি নদীর বালুচরে চাষ করা হয়েছে বোরো ধান।
অধিকাংশ চাষীই গত ৮/১০ বছর থেকে জেগে ওঠা চরে বোরো ধান চাষ করছেন। নভেম্বর মাস থেকে নদীতে পানি কমে গেলে বালুচরের জায়গা নিজেদের দখলে নিয়ে বোরো চাষের উপযোগী করে তোলার জন্য কাজে নেমে পড়েন চাষীরা। মাস দুয়েক পরিশ্রম করে বেদা ও কোদাল দিয়ে বালু সরিয়ে আইল বেঁধে পানি আটক করা হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে জমি সমান করার পর বোরো ধান রোপন করা হয়।
চাষীরা জানায়, নদীতে বোরো ধান চাষে বিঘা প্রতি খরচ হয় প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। বিপরীতে এক বিঘা জমিতে ধান আসে ২২ থেকে ২৫ মণ। তা দিয়েই ভূমিহীন কৃষকদের কয়েক মাসের খাবারের জোগান হয়। আগাম ধান লাগানোর কারণে জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম সপ্তাহে ফসল ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশা করছেন তারা।
ভূমিহীন দিনমজুর জহিরুল ইসলাম। ৫ মেয়ে ও ১ ছেলেকে নিয়ে স্ত্রীসহ প্রায় ১০ বছর ধরে বাস করছেন জেলার সদর উপজেলার ডুডুমারী আশ্রয়ণ প্রকল্পে। নিজের জমি না থাকায় বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তালমা নদীতে ১ বিঘা জমি গত কয়েক বছর থেকে বোরো ধান চাষ করে আসছেন। এ জমির ধান থেকেই তার পরিবাররের কয়েক মাসের খাবারের জোগান হয়।
জেলা সদরের পুরাতন ক্যাম্প এলাকার ভূমিহীন আবু তালেব (৩২) এবার করতোয়া নদীতে ২ বিঘা বোরো ধান লাগিয়েছেন।
তিনি জানান, বর্ষার সময় পানির সাথে যে পলি পড়ে তা আমাদের ধান ক্ষেতের সার হিসেবে কাজে লাগে। তাই অতিরিক্ত সার দিতে হয় না। তবে নদীতে ধান লাগানো অনেক চাষীই আগাম বর্ষার আশঙ্কা করছেন।
ভূমিহীন আব্বাস আলী জানান, ভারত থেকে হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দিলে আমাদের এই কষ্টের আবাদ একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে। আগাম বর্ষা হলে ধান ডুবে যেতে পারে তাই আমরা একটু তাড়াতাড়ি ধানের চারা রোপন করছি। গত বছর অনেক চাষীর ধান ডুবে গিয়েছিল। ফলে অনেক চাষীকেই লোকসান গুণতে হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলার ছোট-বড় সকল নদীতেই বোরো ধান চাষাবাদ হয়েছে। সাধারণ ব্রি-২৮, ব্রি-৩২ জাতের ধান চাষাবাদ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে জেলার ছোট-বড় ২৫ টি নদীর বালুচরে সহস্রাধিক চাষী প্রায় ১৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান লাগিয়েছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক স. ম. আশরাফ আলী জানান, নদীর তীরবর্তী দরিদ্র জনগোষ্ঠীরা নদীতে বোরো চাষ করেছেন। আগে এসব বালুচর পতিত থাকত। নদীর এসব পতিত জমিতে বোরো চাষে চাষীরা সচ্ছলতা পাচ্ছেন। সেই সাথে এই মৌসুমে কৃষকদের বোরো চাষের পাশাপাশি নদীতে চাষ করা বোরো ধান আমাদের সাধারণ উৎপাদন লক্ষমাত্রায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। নদীতে চাষাবাদে ভূমিহীনদের আর্থিক অনটন ঘুচবার পাশাপাশি জেলার খাদ্য চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/কেজেএইচ
নিউজবাংলাদেশ.কম








