প্রখ্যাত বামপন্থী চিন্তক ও লেখক বদরুদ্দীন উমর আর নেই

ফাইল ছবি
দেশের প্রখ্যাত চিন্তক, লেখক, শিক্ষক ও বামপন্থী রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর ইন্তেকাল করেছেন।
রবিবার (০৭ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা ৫ মিনিটে তিনি রাজধানীর শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন উমর। রবিবার সকালে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্সও এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, আজ সকালে উমর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে অসুস্থ অবস্থায় স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে আসার পর সকাল ১০টা ৫ মিনিটে তার মৃত্যু হয়। বিস্তারিত তথ্য আমরা পরে জানাবো।
বদরুদ্দীন উমর ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বর্ধমান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবুল হাশিম এবং মাতার নাম মাহমুদা আখতার মেহেরবানু বেগম। তাঁর পিতা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এবং অখণ্ড বাংলার পক্ষে কাজ করেছেন। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। ১৯৫০ সালে নানা অনিশ্চয়তায় পরিবার ঢাকায় চলে আসে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে উমর এবং তার পিতা দুজনেই সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
উমর তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা বর্ধমান টাউন স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৫০ সালে বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি এবং ১৯৫৫ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন্স কলেজে ভর্তি হন এবং ফিলোসফি, পলিটিক্স অ্যান্ড ইকোনমিক্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
পেশাজীবন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজে দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে ১৯৬৩ সালে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। একই সময় তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কার্যক্রমও নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৮ সালে শিক্ষকতা থেকে পদত্যাগ করে সরাসরি বিপ্লবী রাজনীতিতে যুক্ত হন।
আরও পড়ুন: টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর
উমর ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ‘সংস্কৃতি’ নামে একটি রাজনৈতিক সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত পার্টির মুখপত্র ‘গণশক্তি’ সম্পাদনা করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পার্টির নীতি-রেখার সঙ্গে মতাদর্শিক ভিন্নতার কারণে ডিসেম্বরে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (ইপিসিপি) থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের প্রসার ও নেতৃত্ব গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন।
তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবির, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। ২০০৩ সালে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী হিসেবেও ছিলেন।
উমরের গবেষণামূলক কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (তিন খণ্ডে), ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতি’, ‘বাঙালীর সমাজ ও সংস্কৃতির রূপান্তর’, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ’, এবং ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক’।
উমর নিজে তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’-এ লিখেছেন, আমার জন্ম হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরে ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর, রোববার, দুপুর দুটোয়।
২০২৫ সালে তাঁকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তবে তিনি ব্যক্তিগত নীতি অনুযায়ী এটি গ্রহণ করেননি।
উমর একটি বিবৃতিতে বলেন, ১৯৭৩ সাল থেকে আমাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আমি সেগুলোর কোনোটি গ্রহণ করিনি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেছে। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ, কিন্তু আমি এটি গ্রহণ করতে পারছি না।
বদরুদ্দীন উমরের বয়স ছিল ৯৪ বছর। দেশের সাহিত্য, শিক্ষা, রাজনীতি এবং গবেষণা ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অতুলনীয়। বামপন্থী রাজনীতি থেকে শুরু করে গবেষণা, সমাজ ও কৃষক আন্দোলন—প্রত্যেক ক্ষেত্রে তিনি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্ব প্রদর্শন করেছেন। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক সম্প্রদায় আজ তাঁর অবর্তমানতায় শোকস্তব্ধ।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি