News Bangladesh

নিউজ ডেস্ক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভিসা জটিলতায় বিদেশযাত্রায় বাড়ছে ভোগান্তি, কমছে সম্ভাবনা

ভিসা জটিলতায় বিদেশযাত্রায় বাড়ছে ভোগান্তি, কমছে সম্ভাবনা

ফাইল ছবি

পড়াশোনা, চিকিৎসা, ভ্রমণ কিংবা কাজ, সব ক্ষেত্রেই বিদেশে ভিসা পাওয়া এখন বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও অনেকে ভিসা না পেয়ে হতাশার শিকার হচ্ছেন। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ হারানো, চিকিৎসা নিতে না পারা এবং ভ্রমণ পরিকল্পনা বাতিল করার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। শুধু ভ্রমণপিপাসু, শিক্ষার্থী বা কর্মপ্রত্যাশী নন, এই জটিলতা ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ব্যাপক হতাশা সৃষ্টি করেছে।

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সদরের বাসিন্দা নাদির হোসেন ফেসবুকে তার হতাশার কথা প্রকাশ করে জানান, দুইবার আবেদন করেও তিনি মধ্য এশিয়ার দেশ তাজিকিস্তানের ভিসা পাননি।

তিন সপ্তাহ অপেক্ষার পরও তার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, আজ আমি তাজিকিস্তানের ই-ভিসার জন্য রিজেক্ট হয়েছি। এই ভিসাটিকে সাধারণত বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের জন্য সবচেয়ে সহজ ভিসাগুলোর একটি বলে ধরা হয়।

নাদির হোসেনের মতো বাংলাদেশের অধিকাংশ ভ্রমণপিপাসু, শিক্ষার্থী ও কর্মপ্রত্যাশী একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। গত দুই-আড়াই বছর ধরে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ভিসা পেতে জটিলতা বেড়েছে এবং গত এক বছরে ভিসা প্রত্যাখ্যানের হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভিসা জটিলতার পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা।

জাল কাগজপত্র: অনেক ক্ষেত্রে ভিসা আবেদনের জন্য জাল বা ভুয়া কাগজপত্র জমা দেওয়া হচ্ছে, যা দূতাবাসগুলোর কঠোর যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় ধরা পড়ছে। সম্প্রতি ঢাকার থাই দূতাবাস এক বিজ্ঞপ্তিতে জাল কাগজপত্র ব্যবহারকারীদের সতর্ক করে জানিয়েছে, এমন আবেদন সরাসরি বাতিল করা হবে।

অবৈধ অবস্থান: ভিসা পাওয়ার পর নির্দিষ্ট দেশে নির্ধারিত সময়ের বেশি অবস্থান করা, অবৈধভাবে কাজ করা অথবা তৃতীয় কোনো দেশে চলে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাবেক একজন কূটনীতিকের মতে, এটিই সবচেয়ে বড় সমস্যা। যেমন, ভিজিট ভিসায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে কাজ খোঁজার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় দেশটি ভিসা সীমিত করেছে।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা: অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ জানান, এটা আসলে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিদেশে গিয়ে পালিয়ে যাওয়া এবং ভ্রমণ ভিসায় গিয়ে দীর্ঘদিন অবস্থান করে চাকরি করাকে তিনি ভিসা জটিলতার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

দক্ষ কর্মীর অভাব: অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈধ পথে বিদেশ গমনে আগ্রহী অনেক কর্মীর দক্ষতার অভাবও একটি কারণ।

বাংলাদেশিদের জন্য বর্তমানে দুই ধরনের ভিসা জটিলতা তৈরি হয়েছে—একটি ভ্রমণ ভিসা এবং অন্যটি কর্মী ভিসা।

ভ্রমণ ভিসার ক্ষেত্রে

  • এশিয়ার দেশসমূহ: মামুন চৌধুরী নামের এক ব্যবসায়ী সম্প্রতি তৃতীয়বারের মতো থাইল্যান্ডের ভিসা প্রত্যাখ্যান হওয়ার কারণে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তার মতো আরও অনেকের আবেদন সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক ও মিসরে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। মিসরে অন-অ্যারাইভাল ভিসার শর্ত আরও কঠোর করা হয়েছে, যেখানে আবেদনকারীদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, শেনজেনভুক্ত দেশ, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা অথবা নিউজিল্যান্ডের বৈধ ভিসা থাকার পাশাপাশি কমপক্ষে ৫ হাজার মার্কিন ডলারের ব্যাংক স্টেটমেন্ট থাকা বাধ্যতামূলক।
  • ইউরোপের দেশসমূহ: ইউরোপের ভিসা আগে থেকেই কম দেওয়া হলেও ২০২৪ সালের আগে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ার কারণে এখন ৮০ শতাংশের বেশি আবেদন বাদ পড়ে যাচ্ছে। ইউরোপের অনেক দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে নেই, তাই ভিসা আবেদন দিল্লিতে অবস্থিত দূতাবাসে জমা দিতে হয়। কিন্তু ভারতে ভ্রমণ ভিসা বন্ধ থাকায় এই প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি বেলজিয়ামের ভিসা ঢাকা থেকে ইস্যু করা একেবারেই বন্ধ করে দিল্লি থেকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: নভেম্বরে প্রবাসী ভোটের নতুন অ্যাপ

শ্রমবাজারের অবস্থা: বন্ধ বা সীমিত ভিসা

বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য অনেক দেশের শ্রমবাজার বর্তমানে বন্ধ বা সীমিত করে দেওয়া হয়েছে।

  • সংযুক্ত আরব আমিরাত: ২০১২ সাল থেকে আমিরাতে বাংলাদেশিদের জন্য কাজের ভিসা সীমিত। গত বছর জুলাই আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কিছু বাংলাদেশি বিক্ষোভ করায় সব ধরনের ভিসা ইস্যু বন্ধ করে দেয় দেশটির সরকার। আমিরাতে ভিসা ও অবস্থানের নিয়ম ভাঙার ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশের বেশি ঘটনা বাংলাদেশিরা ঘটায় বলে জানিয়েছেন আমিরাত সরকারের কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সুহাইল সায়িদ আল খালিল। বর্তমানে শুধু 'স্কিল ভিসা' বা হাই-প্রোফাইল ভিসা চালু আছে।
  • মালয়েশিয়া: দুর্নীতির অভিযোগে গত বছরের ৩১ মে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিএমইটির ছাড়পত্র পাওয়া ১৬ হাজার ৯৯০ জন কর্মী দেশটিতে যেতে পারেননি। বর্তমানে শুধু প্লান্টেশন সেক্টরে কর্মী নেওয়া হচ্ছে, তবে এই হার খুবই কম।
  • ইতালি: গত বছর ১৭ অক্টোবর ইতালির শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। কারণ হিসেবে জানানো হয়, বিপুল সংখ্যক জাল নথির কারণে সরকার ১১ অক্টোবর পর্যন্ত ইস্যু করা সব কর্ম অনুমোদনের বৈধতা স্থগিত করেছে। তবে নতুন নিয়ম অনুযায়ী প্রায় ২০ হাজার সম্ভাব্য আবেদনকারীর ওয়ার্ক পারমিট যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শিগগিরই শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
  • অন্যান্য দেশ: ২০১৮ সালে এক বাংলাদেশির হাতে এক ইমাম হত্যাকে কেন্দ্র করে বাহরাইনের শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে। ওমান গত বছর কর্মী ভিসা বন্ধ করলেও ২০২৪ সালের জুন থেকে চিকিৎসক, নার্স, প্রকৌশলী, শিক্ষক, হিসাবরক্ষক ও উচ্চ আয়ের পেশাজীবীদের জন্য ভিসা আবারও চালু করেছে। এছাড়া লিবিয়া, সুদান, ব্রুনাই, মরিশাস ও ইরাকে কাজের ভিসা এখনো বন্ধ রয়েছে।

ভিসা জটিলতা নিরসনে সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছর ডিসেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৯টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ভিসা সেন্টার দিল্লিতে থেকে ঢাকায় বা অন্য কোনো প্রতিবেশী দেশে স্থানান্তরের প্রস্তাব দেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানান, বুলগেরিয়া তাদের ভিসা সেন্টার ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে স্থানান্তর করেছে। তবে করোনা মহামারির পর থেকে ইন্দোনেশিয়ার অন-অ্যারাইভাল ভিসা এবং ভিয়েতনামের ভিসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করছি। কিছু কিছু মিশনকে বিকল্প কী করা যায় সে বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিকল্প মানে ভারতের বিকল্প। মিশনগুলোকে বলা হয়েছে, ইউরোপের যে দেশগুলোয় বাংলাদেশের মিশন আছে, ভিসা সেন্টার আছে, সেই দেশগুলোকে বাংলাদেশিদের জন্য ভারত থেকে ভিসা সেন্টার সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করা। কিন্তু তাদের নিজস্ব মতামত রয়েছে। আমরা বললেই যে তারা সরিয়ে নেবে তা না। কিন্তু আমরা নিয়মিত অনুরোধ করছি।

অন্যদিকে, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভিসা দেওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দেশের সার্বভৌম এখতিয়ার। এ ক্ষেত্রে সরকারের তেমন কিছু করার নেই। তারপরও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দূতাবাসগুলোকে নিয়মিত তাগিদ দেওয়া হয়ে থাকে।

ভিসা ভোগান্তির কারণে হতাশ নাদির হোসেনের মতো আরও অনেকে ফেসবুকে নিজেদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করছেন।

কামরুল ইসলাম নামের একজন লিখেছেন, ‘আমার দেখা সবচেয়ে সহজ ভিসা ছিল তাজিকিস্তানের। দিল্লি থেকে মাত্র ১৫ মিনিটে স্টিকার ভিসা চোখের সামনে প্রিন্ট করে পাসপোর্টে লাগিয়ে দিয়েছিল ২০২৪ সালে। আর আমাদের দেশের কিছু মানুষের কারণে এখন আমাদের এমন অবস্থা। ভিসা না পাওয়ার মূল কারণ আমরা নিজেরাই।’

জুয়েল খান নামের আরেকজন ট্রাভেলার লিখেছেন, ‘১০-২০টা রিজেকশন হলেও কোনো ট্রাভেলার থেমে যায় না। আমি ভারতে তিনবার, সিঙ্গাপুরে তিনবার, থাইল্যান্ডে একবার ও দক্ষিণ কোরিয়ায় দুবার রিজেক্ট হয়েছি।’

শিক্ষার্থী আশরাফুল গনি তার হতাশা প্রকাশ করে লেখেন, ‘আমারও দুবার মালয়েশিয়ার ভিসা রিজেক্ট আসছে। আমারটা স্টুডেন্ট ভিসা। তার পরও রিজেক্ট?’

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে অবৈধ অভিবাসন রোধ, দক্ষ জনশক্তি তৈরি, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ এবং শক্তিশালী কূটনৈতিক উদ্যোগ অপরিহার্য। তবে এখন পর্যন্ত দেশের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলোতে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়