এমন বিজ্ঞানী কেন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন?
বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন বিখ্যাত কসমোলজিস্ট, গণিতবিদ ও পদার্থবিদ। কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত তার লেখা ‘দ্য আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স’ (১৯৮৩) গ্রন্থ দুনিয়া কাঁপিয়েছিল। পৃথিবীর বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে তার এ বইটি পড়ানো হয়। পৃথিবীর বাঘা বাঘা পদার্থবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, অর্থনীতিবিদ, নোবেল বিজয়ীরা ছিলেন তার বন্ধু, সহপাঠী এবং সহকর্মী।
বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম-১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, মৃত্যু-২০১৩ সালের ১৬ মার্চ।
আপেক্ষিক তত্ত্বকে ঘিরে তিনি যে দীর্ঘ ৪০ বছর গবেষণা করছিলেন এমন উদাহরণ পৃথিবীতে বিরল। কেমব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহ ত্যাগ করে দেশে ফিরে মাত্র ২৮শ টাকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ নেন তিনি। পৃথিবীর সেরা গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানীরা এখানেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করে তিনি হাতে লিখতেন। ধ্রপদী সংগীতের মগ্নতায় বিজ্ঞানকে ভালোবেসে আজীবন কাজ করে গেছেন।
`দ্য আলটিমেট ফেট অব ইউনিভার্স` বইয়ে জামাল নজরুল ইসলাম লিখেছেন, `রাতের জীবরা দিনের আলোকে আকর্ষণীয় মনে করবে না, যেমন দূর ভবিষ্যতের অতি-শীতল মহাবিশ্বের অজানা সচেতন প্রাণীরা আমাদের উষ্ণ মহাবিশ্বকে হয়তো খুব একটা আরামদায়ক হিসেবে দেখবে না। কিন্তু তবুও, তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনকে হয়তো পাওয়া যাবে যাদের কল্পনাশক্তি প্রখর, তারা দূর অতীতে, মহাবিশ্বের দিকে ফিরে তাকাবে, দেখবে একটা সূর্যালোক প্লাবিত প্লথিবীকে, যেখানে কয়েক কোটি বছরের শক্তি সরবরাহ নিশ্চিত, তারা সেই পৃথিবীকে এক স্বপ্নের জগৎ বলেই ভাববে- কিন্তু তাদের জন্য সেই স্বপ্নের জগৎ হারিয়ে গেছে, কোনদিন ফিরে আসবে না।’
কিন্তু বর্তমানে আমরা যারা এই স্বপ্নের পৃথিবীকে নিয়ে আছি, তারা কী করছি? আমরা একে অপরকে অত্যাচারে জর্জরিত করছি, নিজেদের ধ্বংসের জন্য পরমাণু মারণাস্ত্র তৈরি করছি, আর পৃথিবীর সম্পদকে অবাধে লুট করছি।
তাঁর রচনা ও গবেষণাপত্র পড়ে ওই সময়ের বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখকেরা খুবই প্রভাবিত হয়েছিলেন। ওয়াইনবার্গের বিশ্বকে নৈরাশ্যজনক বলে মতামত ব্যক্ত করলেও ফ্রিম্যান ডাইসন জামালের রচনায় অনুপ্রাণিত হয়ে আশাবাদী বিশ্বের কথা বলেছিলেন। তাঁর মতো এমন বিজ্ঞানী কেন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন? যেখানে অর্থনৈতিকভাবে শুধু নয় বৌদ্ধিকভাবেও তিনি ছিলেন সেরা অবস্থানে। পৃথিবীতে তার সময়ের সবচেয়ে গভীর এবং বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের সঙ্গে তার আদানপ্রদান ছিল, তাদের কাছে তার গুরুত্বও ছিল। ওখানে থাকলে কৌশলগতভাবে অনেক ধরনের সহযোগিতা পেতেন।
‘স্টিডি স্টেট’ তত্ত্ব পরিত্যক্ত হলে এই তত্ত্বের প্রবক্তা ফ্রেড হোয়েল ও নারলিকার সমকালীন বিজ্ঞানীদের চাপে ছিলেন। জামাল নিজে স্টিডি স্টেট তত্ত্বের সমর্থক না হলেও ফ্রেড হোয়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তার গায়েও এর আঁচ লেগেছিল। হয়তো হোয়েলের সঙ্গে সাহচর্যের কারণেই অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের মূল্যায়ন পশ্চিমে যতটা হওয়ার কথা, ততটা হয়নি। সেখানে অবস্থান করা তার জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল। শুধু এ কারণেই তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন? তার মতো মানুষের বেলায় এটা সম্ভবত সম্পূর্ণ ঠিক নয়। তাহলে দেশপ্রেম? আমার মনে হয় না তা তার কম ছিল। বাংলাদেশের মানুষের বিপদ-আপদে সবসময় তিনি তাঁর মতো করে এগিয়ে এসেছেন। সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে কাজ করেছেন।
নিজের দেশে থেকে কাজ করার সুবিধা? ‘আলটিমেট ফেট অফ দ্য ইউনিভার্স’ গ্রন্থে তাঁর উক্তি বা তাঁর বক্তৃতা থেকে বোঝা যায় আঞ্চলিকভাবে খণ্ডিত অংশের সমগ্র হিসেবে পৃথিবীকে তিনি দেখেননি। দেখেছেন একটি অখণ্ড ব্যবস্থা হিসেবে। একটি অংশের সমস্যার সাথে আরেকটি অংশের সমস্যা নিগুঢ়ভাবে জড়িত। পৃথিবীর মৌলিক সমস্যাগুলো থেকে বের না হয়ে এলে আঞ্চলিক সমস্যাগুলোও কাটবে না। কার্ল সাগানের ভাষায় পৃথিবী না বাঁচলে দেশও বাঁচবে না। দেখতে জানলে এই পৃথিবীর সব জায়গাই মহাজাগতিক সাগরের বেলাভূমি।
তাহলে কেন তিনি ফিরে এসেছিলেন এই শ্যামল বাংলায়? হয়তো বৌদ্ধিকভাবে এমন এক স্তরে দাঁড়িয়ে ছিলেন যেখান থেকে তিনি সম্ভবত অনুভব করতেন, কর্মস্থলে ট্রেনে যেতে যেতে আপন মনে ভাবতেনও। উপলব্ধি করতেন জন্মভূমির মাটিকে আত্তীকরণ করে যদি মহাবিশ্বকে দেখা না-যায়, আকাশের দিকে তাকানো না হয় তাহলে শুধু নিজের ভেতরের অসম্পূর্ণতাই থাকে না, নিজের অবস্থানকেও অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এটা তো কোনো চাকরি বা টেকনোক্রাট হিসেবে অবস্থান নয়, এটা হলো নিজের জন্মভূমির পলিমাটিবাহিত বাংলার সঙ্গে বিশ্বকে সম্পর্কিত করা। সেই মন নিয়ে, যে মনের জোরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা নদী থেকে নদীতে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছে, পলিমাটির অঞ্চলে গড়ে তুলেছে তাদের আবাসভূমি। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে জীবন নিঃশেষিত করে ফসল ফলিয়েছেন আর তৈরি করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অপেক্ষাকৃত মসৃণ পথ। ক্ষয়িষ্ণু, কষ্টকর আর সর্পিল পথে জীবনকে প্রবাহিত করেছে পদ্মা-মেঘনা আর মধুমতির স্রোতধারায়। পলি হয়ে জমেছে নদীর বাঁকে বাঁকে। অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সময় পেলেই তারা প্রশ্ন করেছে জীবনের উৎস, পরিণতি আর ওই নক্ষত্রগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে। তারা নিশ্চয়ই ভেবেছে রেখে যাওয়া প্রজন্ম সেই মাঝি আর কৃষকের মন নিয়ে মহাকাশ আর মাটির সঙ্গে জীবনের সম্পর্ককে উদঘাটিত করবে। এটাইতো শিকড়ের অনুসন্ধান।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় প্রবল ভিড়ে চলন্ত ট্রেনের পাহাড়ি পথে একাকী ধ্রপদী সংগীতের মগ্নতায় অথবা কখনো কর্ণফুলীর স্রোতধারায় ভাসতে ভাসতে তিনি সেই শিকড়ের খোঁজ করবেন বলেই ফিরে এসেছিলেন এই বাংলায়।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এএইচকে
নিউজবাংলাদেশ.কম








