News Bangladesh

যশোর সংবাদদাতা || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৪:১২, ২০ আগস্ট ২০২৫

অনিয়ম-দুর্নীতিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে যশোরের সরকারি মৎস্য হ্যাচারি 

অনিয়ম-দুর্নীতিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে যশোরের সরকারি মৎস্য হ্যাচারি 

ছবি: নিউজবাংলাদেশ

অব্যবস্থাপনা আর অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সম্ভাবনাময় পাকিস্তান আমলের যশোরের মৎস্য হ্যাচারিটি মুখ থুবড়ে পড়েছে।

প্রযাপ্ত সরকারি জনবল ও বরাদ্দ সবই রয়েছে। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারি অনিয়ম দুর্নীতির কারণে দেশের যুবদলের সভাপতির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ একসময়ের সুনাম অর্জনকারী মৎস্য এ হ্যাচারি থেকে গত দেড় যুগে দেশের প্রান্তিক মৎস্য চাষিদের কল্যাণে আসেনি। সরকারি সব সুযোগ সুবিধা গ্রহণ ও হ্যাচারি উন্নয়নের বরাদ্দের অর্থ নানা কৌশলে গিলে খাচ্ছে কর্মকর্তাও কর্মচারীরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, যশোরের প্রাণ কেন্দ্র নামে পরিচিত যশোর শহরের মনিহার ও আইটি পার্কের মধ্যবর্তী বেজপাড়াতে ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি আমলে এই অঞ্চলে মৎস্য উন্নয়নের লক্ষ্যে ২.৪২ হেক্টর বা প্রায় ১৯ বিঘা জমির উপরে প্রতিষ্ঠিত হয় সরকারি মৎস্য হ্যাচারি। রেণুপোনা উৎপাদনের জন্য হ্যাচারির ভিতরে খনন করা হয় আটটি পুকুর। স্থাপন করা হয় উৎপাদনের যন্ত্রপাতি ও আবাসিক স্থাপনা। সেই থেকে এখানে মা মাছ উৎপাদন, ডিম সংরক্ষণ ও বাচ্চা উৎপাদনে প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এ হ্যাচারিটি এখন প্রায় বন্ধ।

সরকারি প্রতিষ্ঠানে বা সরকারি মালিকানাধীন বাওড়ে রেণু পোনা সরবরাহে রয়েছে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ। ১০ হাজার ছাড়লে বিল করা হয় ২০ হাজারের। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে রেণুপোনা ক্রয় করে সেগুলো সরবরাহ করা হয়। চাকরি বাঁচাতে খাতা-কলমে নামসর্বস্ব উৎপাদন দেখিয়ে সরকারের লাখ লাখ টাকা তসরুপ করছে সরকারি কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে আরও জানা গেছে, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মৎস্য বীজ উৎপাদন ও রেণু উৎপাদনে লক্ষ্যে হ্যাচারি মেরামত ও সংস্কারের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় পাঁচ লাখ ত্রিশ হাজার টাকা। নাম সর্বস্ব কাজ দেখিয়ে এসব টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। 

সূত্র আরো জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪.৮৩৫ টাকা থেকে ৭.১৪৫ টাকা। ওই বছরে একই টাকা আয় দেখানো হয়। তার আগের বছর ২২-২৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪.৭৭৫ টাকা থেকে ৭.০৬ লাখ টাকা । ওই বছরই একই টাকা খামারের আয় দেখানো হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪.৫২৫ লাখ টাকা থেকে ৬. ৮০ লাখ টাকা। ওই বছরেও একই টাকা আয় দেখানো হয়। 

২০২১ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত লক্ষণ নির্ধারণ করা হয় ২.০৭ লাখ টাকা থেকে ৩.১৪৫ টাকা। ওই অর্থবছরেও ও আয় দেখানো হয়, নির্ধারণের একই টাকা। নাম সর্বস্ব এ চার্টার্ডে দুর্নীতির অনিয়ম চিত্র ফুটে উঠেছে।

আরও পড়ুন: বর্ষায় মাচায় চাষ হচ্ছে সুস্বাদু মার্সেলো তরমুজ, খুশি নওগাঁর কৃষকরা

এছাড়া খামার উন্নয়নে ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ১০ লাখ ৩০ হাজার ১০০ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ দিয়েছেন ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৮০০, ২২- ২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০, ২৩-২৪ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬ লাখ হাজার ১৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নে ব্যয় করা হয় ৩৫ লাখ ৮৭ হাজার ৯০০ টাকা। 

এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা কর্মচারীর বেতন নেন বছরে প্রায় বিশ লাখ টাকার অধিক। সর্বসাকুল্যে প্রতিষ্ঠানটি অর্ধ কোটি টাকার ও বেশি সরকারকে ব্যয় করতে হয়। অথচ বছরে এ প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারের আয় দেখানো হয় মাত্র পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে।

বসুন্দিয়ার ঘুনি গ্রামের মাছ চাষি ময়নাল হাসান বলেন, আমি কয়েকবার সরকারি মাছের হ্যাচারিতে গিয়েছি। কিন্তু কখনোই কোন রেণুপোনা পাইনি। গেলেই বলে এখন কার্যক্রম বন্ধ আছে। সব সময় যদি বন্ধ থাকে তাহলে সরকারের এই সম্পদ ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বসিয়ে বসিয়ে বেতন ভাতা ও বরাদ্দ দিয়ে লাভ কি। 

তিনি বলেন, এখানে প্রতি শতক জায়গার দাম কম করে হলো অর্ধ কোটি টাকা। তাহলে এগুলো ইজারা বা সরকারী মার্কেট করে দিলেও সরকারের বছরে কয়েক কোটি টাকা আয় হবে।

অভয় নগরের মৎস্য চাষি রেজওয়ান আহমেদ বলেন, আমরা কম মূল্যে ভালো মানের চারা মাছ ক্রয় জন্য কয়েক দফায় সরকারি খামারটিতে যাই। কিন্তু সেখান থেকে জানানো হয় তাদের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বিপুল পরিমাণের জায়গা ও জনবল থাকা সত্বেও এখান থেকে কোন সরকারের আয় হয় না এবং এই অঞ্চলের প্রান্তিক মৎস্য চাষিদেরও কোন উপকারে আসে না। অথচ এখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে চাঁচড়ায় বেসরকারি মালিকানায় প্রায় অর্ধশতধিক হ্যাচারি করে তারা বছরে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করছে। কিন্তু সরকারের সব সুযোগ সুবিধা থাকার পরেও সরকারি মৎস্য হ্যাচারিটির কার্যক্রম বন্ধ থাকে এবং এ অঞ্চলের মৎস্য চাষিদের কোন কল্যাণে আসছে না। এটা অত্যন্তের দুঃখের বিষয়। অথচ এক সময়ে এ অঞ্চলের প্রান্তিক মৎস্য চাষিদের একমাত্র রেণুপোনা সংগ্রহের কেন্দ্র ছিল এই হ্যাচারি।

যশোর চাঁচড়া মৎস্য সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ১৯৮০ দশকে যশোরের চাঁচড়া বাণিজ্যিকভাবে বেসরকারি মৎস্য হ্যাচারি শুরু হলেও ২০১০ সালের পর থেকে চাঁচড়ার হ্যাচারিগুলোয় দেশি ও বিদেশি জাতের মাছের পোনা উৎপাদনে বিপ্লব ঘটতে শুরু করে। স্বল্প পরিসরে মূলধন ও পুকুর নিয়ে এ ব্যবসা করে অনেকেই কোটিপতি হয়েছেন। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে। এটার কারণ হলো প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ম দুর্নীতি ও সরকারি কর্মকর্তাদের অবহেলা। বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত রেণু মাছের মধ্যে যশোরে বেসরকারি মৎস্য হ্যাচারিতে উৎপাদিত হয় ৭০ শতাংশ রেণু পোনা। উৎপাদিত পোনার মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, গ্রাসকার্প, বিগহেড, থাই সরপুঁটি, মিরর কার্প, চিতল, আইড়, তেলাপিয়া, মনোসেক্স তেলাপিয়া, শিং, কৈ, থাই কৈ, পাঙাশ ইত্যাদি।

সরকারি মৎস্য হ্যাচারিটি দিন দিন রুগ্ন হয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে হ্যাচারিটির ব্যবস্থাপক লিপি পাল বলেন, আমাদের এখানে সঠিক সময় বরাদ্দ না থাকা ও জনবলের অভাবের কারণে আমরা হ্যাচারি সব সময় চালু রাখতে পারি না। তবে আমাদের এখানে যথেষ্ট পরিমাণ বুরুড মাছ আছে বলে তিনি দাবি করেন। বরাদ্দের অর্থ তাদের খাদ্য খাবার ও পরিচর্যায়ে ব্যয় করা হয় বলে তিনি জানান।

নিউজবাংলাদেশ.কম/এনডি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়