News Bangladesh

আসাদুল হক খোকন || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৪:১৭, ১৬ জুন ২০২৫

হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়

হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়

ছবি: ইন্টারনেট

ছোট বেলায় আমার আম্মার মুখে নামটি প্রথম শুনি। আম্মা আমার নানাজানের গ্রামোফোন রেকর্ডে তার গান শুনেছেন। নানাজান আব্বাস উদ্দীনের পাশাপাশি তার রেকর্ডও বাজাতেন। সেই থেকে এই শিল্পী তার বিশেষ প্রিয়। 

আম্মার বিয়ের পর 'গানবাজনা হারাম' ঘোষিত শশুর বাড়িতে এসে গান শোনা হয়নি অনেকদিন। কিন্ত গানবাজনা বিষয়ে কোন আলাচনা উঠলেই আম্মা তার প্রিয় শিল্পীর কথা বলতেন। বলতেন- তার সুর, কন্ঠ, আর গায়কী অসাধারণ।

এভাবে নানাজানের এবং আম্মার পছন্দের শিল্পী মেহেদী হাসান- এর নাম সেই শৈশবেই আত্মস্থ হয়ে গিয়েছিল। তার ভরাট কণ্ঠের যাদু আম্মাকে সম্মোহীত করে রেখেছে বহুদিন।
 
একবার ১৯৮৫ সালে সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে বিশেষ আমন্ত্রণে ঢাকায় আসেন মেহেদী হাসান। তার সে অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে। আমাদের তখন কোন টিভি নেই। ইউনিয়ন পরিষদের সৌজন্যে পাওয়া গ্রামবাসীর জন্য একমাত্র টেলিভিশন রাজেন্দ্র ডাক্তারের বাড়িতে। সেখানে তাই ১৪ ইঞ্চি সাইজের সাদা-কালো সে টিভিতে অনুষ্টান দেখতে প্রতিদিন জড়ো হয় গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ। ভালো কোন অনুষ্টান থাকলে রাজেন্দ্র ডাক্তার লোক পাঠিয়ে খবর দেন আব্বাকে। সেবার খবর এলো- সন্ধ্যায় টিভিতে সার্ক অনুষ্টান দেখাবে। পাকিস্থানের মেহেদী হাসান গজল পরিবেশন করবেন এই অনুষ্ঠানে।

খবরটি আম্মার কানে গেল। না দেখেই এতদিন যার গজল শুনে আম্মা আমাদের গল্প শুনিয়ে এসেছেন, আজ তাকে সরাসরি দেখা যাবে এ সংবাদ যেন আম্মার জন্য মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।

সেদিন জোৎস্না রাতে আধো অন্ধকারে হ্যারিকেন নিয়ে আব্বা- আম্মা আর নাছুড়বান্দা আমি অনেকটা পথ মাড়িয়ে ডাক্তার বাড়ি টিভি দেখতে গেলাম। দেখতে গেলাম এতদিনে মনের ভেতর গেঁথে থাকা মেহেদী হাসান নামের এক অপরিচিত শিল্পীকে দেখতে।

এক পর্যায়ে আব্বা আর রাজেন্দ্র ডাক্তারের কথোপকথনে বুঝতে পেরেছিলাম-আম্মার মত তারাও এই অচেনা গানওয়ালা লোকটার অন্ধভক্ত।
তারপর আকষ্মিক লোকজনের হৈচৈ থেমে গেলে বুঝতে পারি অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। সাদা-কালো টিভির পর্দায় দেখতে পাই- শ্যামলা মতো সাদা পাজামা পাঞ্জাবির উপর কালো হাতাকাটা কোট পরা একটি শ্যামলা মতো ছোট করে ছেঁটে রাখা গোঁফওয়ালা লোক চোখ বন্ধ করে গান গাইছেন। তার একহাতের আঙুলগুলো হারমোনিয়ামের রিডে ছোটাছুটি করছে। যথানিয়মে শুধু ঠোট নড়ছেন তিনি। কোন কসরৎ বা বাড়তি কস্টের ছাপ নেই তার মুখে। গভীর ধ্যানমগ্ন শিল্পী উর্দু ভাষায় যা গাইছেন তাতে আমি যা ধরতে পারলাম তা হলো- 'রাফতা রাফতা ও মেরি...'। বাকি কথা বুঝতে পারছি না। 

গ্রামের অন্য যারা দর্শক আসনে তন্ময় হয়ে শুনছেন। আমার ধারণা, তারাও খুব একটা বুঝছেন না। তবু পিনপতন নিরবতা! ডাক্তার মাঝে মাঝে আহ্ বলে চোখ বড় বড় করে টিভির দিকে চাইছেন। আর বয়স্কদের কেউ কেউ শুধু গজলের সুরটুকু শুনেই চোখ মুছছেন নিরবে!

এই হলো মেহেদী হাসান। সেই হলো শাহেনশাহ-ই গজল' মেহেদী হাসান।
সেই-ই মূলত আমার গজল প্রেম। তারপর বড় হতে হতে একের পর এক আমাদের সামনে নতুন সব গজল নিয়ে হাজির হয়েছেন তিনি। আমাদের দেশে আসতে কাটাতার অতিক্রম করার সীমাবদ্ধতার কারণে ক্যাসেট প্লেয়ারেই তিনি সীমাবদ্ধ থেকেছেন দীর্ঘকাল। একই কারণে ইচ্ছা থাকা সত্যেও তার জন্মভুমি ভারতেও যেতে পারলেন না শেষ পর্যন্ত!

পরে জানতে পেরেছি ১৯৮৫ সালে শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিওতে শরাফুল ইসলামের নেওয়া সাক্ষাৎকারে মেহেদী হাসান এ সম্পর্কে বলেছিলেন- 'একজন প্রকৃত কণ্ঠশিল্পীর জন্য পাসপোর্টটাই একটা বাঁধা। পাসপোর্ট আমাদের সীমানা তৈরী করে দেয়। ফলে আমারই জন্মস্থান রাজস্থানে যেতে আমাকে ভিসা নিতে হয়। আমরা শিল্পী মানুষ। যখন খুশি চলে যাবো কনসার্ট করতে। কি পাকিস্তান, কি ভারত, কি বাংলাদেশ। অন্তত এই দেশগুলোতে আমাদের ভিসা উন্মুক্ত করে দেওয়া দরকার। তাহলে আর যখন খুশি, যেখানে খুশি কনসার্ট করতে চলে যেতে সমস্যা থাকবে না।'

কিন্ত তবু এই কাটাতার, এই সীমাবদ্ধতা কাটেনি!

ভারতীয় সঙ্গীতের জীবন্ত কিংবদন্তী লতা মুঙ্গেশকরের দেয়া উপাধি- 'দ্য ভয়েস অব গড' আর প্রবাদতুল্য এই গজলশিল্পী সম্পের্ক ভূপেন হাজারিকার মন্তব্য ‘মেহেদী হাসান আমাদের সঙ্গীতের পুরোহিত' তাকে কতটা উচ্চ আসনে অধিষ্টিত করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পন্ডিত রবিশংকরের ভাষায়- ‘যার মাপকাঠি সাগরের মতো গভীর, আকাশের মতো বিশাল' সেই প্রবাদতুল্য গজলশিল্পী মেহেদী হাসানকে আমরা হারিয়েছি। যিনি গজলকে আমাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। আপাদমস্তক যিনি ছিলেন শুধুই শিল্পী আর গজলকে আশ্রয় করে যিনি খুঁজে নিয়েছিলেন আপন ঠিকানা। সারা জীবন অন্য দশজন শিল্পীর মত সঙ্গীতকে টাকার কাছে বিকিয়ে দেননি।’

মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে, তার গজলকে উদাহরণ করে নানামুখি আলোচনা হয়েছে। হচ্ছে এখনো। 

কিংবদন্তী মোহাম্মদ রফির মুগ্ধতার একটি বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের আরও লাখ-কোটি ভক্তের মত মেহেদীর গজল না শুনলে রাতে তারও ঘুম আসতো না। কণ্ঠের ইন্দ্রজাল কতটা সুবিন্যস্ত ও সুবিস্তৃত হলে শ্রোতাকে তাও আবার রফি'র মতো শ্রোতাকে শুধুমাত্র সুরের অদৃশ্য বাঁধনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেঁধে রাখা যায় তা সহজেই অনুমেয় বৈকি!

এ কারণেই, যার কণ্ঠে গান ছিল না সেই আমার আব্বাকে মাঝে মাঝে তার গাওয়া বাংলা গজল ' হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়' গুনগুন করে গাইতে দেখতাম।

পাকিস্তান সরকারের তমঘা-ই-ইমতিয়াজ ও হিলাল-ই-ইমতিয়াজ খেতাব ছাড়াও নেপাল সরকারের কাছ থেকে গোরখা দক্ষিণা বহু খেতাব পেয়েছেন মেহেদী হাসান। সংগীতে অবদানের জন্য আজীবন বহু সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
 
তার মৃত্যুর পর নাগিরক ব্যস্ততা আর লোকচক্ষুকে উপেক্ষা করে আরো অনেকের মত আমিও উচিত কান্নাটুকু কাঁদতে পারিনি।

কিন্তু; মেহেদী হাসানের গজলকে ভালোবেসে আমাদের মজনু ভাই যে আজীবন সংসারী হলেন না। স্কুল জীবন থেকে শুরু করে আমৃত্যু যে মজনু ভাই মেহেদী হাসানের গজল গাইতেন, তার গজল শুনে আবেগে অশ্রু বিসর্জন দিতেন। তার মতো করে গাইতে না পারায় আফসোসে বুক চাপড়ে বলতেন- ' আহ্, ইস্ এইখানে কাঁজটা ঠিকমত হলো না'- এ আর খবর কে রাখে!

আমাদের সেই নির্লোভ মজনু ভাই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তবু সেই দৃশ্য এখনো সতেজ যেন- ধ্যানমগ্ন মজনু ভাই মেহেদী হাসানের গজল শুনছেন নির্নিমেশ মুগ্ধ গোপনতায়-
'ঢাকো যত না নয়ন দু'হাতে
শ্রাবণ মেঘ ঘুমাতে দেবে না'।
 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়