News Bangladesh

পরিতোষ লিমন, সাংবাদিক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৫:১৫, ১২ এপ্রিল ২০২৫
আপডেট: ১২:৩৫, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

ফিলিস্তিন: আগুনে পোড়া ভূখণ্ড ও নিরব বিশ্ববিবেক

ফিলিস্তিন: আগুনে পোড়া ভূখণ্ড ও নিরব বিশ্ববিবেক

ছবি: এপি নিউজ

ফিলিস্তিনে প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যু আর ধ্বংসের সংখ্যা। গাজা উপত্যকা এখন আর শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক এলাকা নয়—এটি আজ সামরিক আধিপত্য, মনাবিক বিপর্যয় ও বৈশ্বিক নিষ্ক্রিয়তার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

২০২৪ সালের শেষ প্রান্ত থেকে ২০২৫ সালের শুরু পর্যন্ত ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী গাজায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তা একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে লজ্জাজনক মানবিক বিপর্যয়গুলোর একটি হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিচ্ছে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এই সংঘাতকে কেন্দ্র করে এক বিস্তৃত কাঠামোতে ঘটনাগুলোর গভীর বিশ্লেষণ, রাজনৈতিক জটিলতা এবং মানবিক চিত্র তুলে ধরেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করবো কীভাবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এই সংঘাতকে পরিবেশন করেছে, কীভাবে বিশ্ব প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং সেইসঙ্গে আজকের বৈশ্বিক মূল্যবোধের অন্তর্নিহিত প্রশ্নগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

গাজায় মৃত্যু ও মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র
গাজা একটি অতি ঘনবসতিপূর্ণ ভূখণ্ড। মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বাস। এই ছোট ভূখণ্ডে বছরের পর বছর অবরোধের মধ্যে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী সামান্য সেবাও পায় না।

২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে ইসরায়েল “Operation Iron Fist” নামে এক অভিযান শুরু করে। যার লক্ষ্য ছিল “হামাসের অবকাঠামো ধ্বংস করা।” কিন্তু বাস্তবে এই অভিযানের সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে সাধারণ জনগণ—শিশু, বৃদ্ধ, মা ও শিক্ষক।

আল জাজিরা তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তুলে ধরে যে, বোমা বর্ষণের শিকার হয়েছে ৮৫টির বেশি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত অন্তত ২৫টি স্কুল ধ্বংস হয়েছে।

দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে বলেছে, “একটি বোমারু ড্রোন গাজায় শিশুদের একটি খেলার মাঠে হামলা চালিয়েছে। কেউ বেঁচে ছিল না।” 

আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, “ইসরায়েল তার আত্মরক্ষার অধিকার বাস্তবায়ন করছে—কিন্তু এই আত্মরক্ষা যদি শিশুর খেলার মাঠে বোমা বর্ষণে পরিণত হয়, তবে সেই প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসকেই দিতে হবে।”

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কী বলছে?
আল জাজিরা, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স, নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএনসহ বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যমই একযোগে ফিলিস্তিনের মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরেছে। আল জাজিরা তাদের ফিচার প্রতিবেদনে গাজায় “বাঁচা মানেই অলৌকিক ঘটনা” শিরোনামে দেখিয়েছে কীভাবে পরিবারগুলো দিনের পর দিন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে, পানি, খাবার, ওষুধ—কোনো কিছুরই যোগান নেই।

গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে বলেছে, “ইসরায়েলের এই যুদ্ধ কৌশল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সীমা অতিক্রম করেছে।” তারা এই আক্রমণকে “collective punishment” হিসেবে উল্লেখ করেছে।

নিউইয়র্ক টাইমস যদিও কিছুটা ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছে, তবুও স্বীকার করেছে যে, "গাজার সাধারণ জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, যাদের অনেকের হামাসের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।"

বিবিসি ও সিএনএন শুরুতে কিছুটা সংযত থাকলেও আন্তর্জাতিক চাপ ও প্রকাশ্য প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে তারা গাজায় শিশু ও নারীর মৃত্যুর সংবাদকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে।

গণমাধ্যমের ভূমিকায় বৈপরীত্য ও দ্বৈততা
একটি বৈশ্বিক সংঘাতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই সংঘাতেও গণমাধ্যমের চিত্র বিভাজিত।  ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে সংবাদ পরিবেশনে সাংবাদিকতার নীতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তারা একপেশে বা ইসরায়েলের প্রতি মিডিয়াগুলোর পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের অভিযোগ করছে।

অনেক আন্তর্জাতিক মিডিয়া যেখানে সত্য তুলে ধরছে, সেখানে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এখনও ইসরায়েলপন্থী বর্ণনা বজায় রাখছে। “Self-defense” শব্দটি ব্যবহার করে এক ধরনের বৈধতা দেওয়া হচ্ছে ইসরায়েলের অভিযানকে। তবে সোশ্যাল মিডিয়া এখন বিকল্প গণমাধ্যমে পরিণত হয়েছে, যেখানে সরাসরি গাজা থেকে ভয়াবহ ভিডিও ও তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে।

দোহাভিত্তিক আল জাজিরা নিরবিচারে গাজা থেকে সরাসরি সম্প্রচার চালিয়েছে। তারা হামলার স্থানে উপস্থিত সাংবাদিকদের মাধ্যমে ধ্বংসযজ্ঞের সরাসরি চিত্র, শিশুদের কান্না ও গর্ভবতী নারীদের মৃত্যুর খবর তুলে ধরেছে। তাদের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “গাজায় এই মুহূর্তে মানবতা মারা যাচ্ছে।”

পোল্যান্ড থেকে ফিলিস্তিনে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসে’ ইসরায়েল

এইসব পশ্চিমা গণমাধ্যম শুরুতে অপেক্ষাকৃত সংযত ছিল। তবে গ্লোবাল চাপ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার বিকল্প সাংবাদিকতার কারণে তারা ধীরে ধীরে গাজায় বেসামরিক মানুষের ওপর আক্রমণের চিত্র তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমস একটি বড় রিপোর্টে লিখেছে,  “যে আক্রমণ আত্মরক্ষার কথা বলে শুরু হয়েছিল, তা এখন এমন একটি মানবিক সংকটে পরিণত হয়েছে, যা আর অস্বীকার করা যাচ্ছে না।”

এই গণমাধ্যমগুলো মূলত ইসরায়েলের “সেল্ফ ডিফেন্স” ও “টেরোরিজম নির্মূল” তত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়েছে। হামাসকে কেন্দ্র করে তারা রিপোর্ট গড়েছে, কিন্তু বেসামরিক মানুষের মৃত্যু নিয়ে নিরব থেকেছে বা তা যথাসম্ভব খাটো করে দেখিয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়া: প্রতিরোধের নতুন পরিক্রমা
গণমাধ্যমে পক্ষপাতিত্বের মাঝেও সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে অন্যতম বিকল্প প্ল্যাটফর্ম। ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, টুইটার (এক্স), ফেসবুক—সব মাধ্যমেই সরাসরি ফিলিস্তিনিদের লাইভ সম্প্রচার, ভিডিও ফুটেজ, এবং আর্তনাদের চিত্র ভাইরাল হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ এই চিত্র দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছে, প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা ছিল নিরব।

একজন গাজাবাসী সাংবাদিক লাইভে বলেছিলেন: “আমার বোনের লাশ পাশে পড়ে আছে। আমি তার চোখ বন্ধ করার আগেই জানতে পারছি, পশ্চিমারা এখনো এটা সেল্ফ ডিফেন্স বলবে।”

বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক দ্বৈতনীতি
বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, ঢাকা, কেপ টাউন—প্রতিটি শহরেই ফিলিস্তিনপন্থী মিছিল দেখা গেছে।
তবে, বড় শক্তিগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র এখনও ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, এমনকি জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। ইউরোপের অনেক দেশ মানবিক উদ্বেগ প্রকাশ করলেও কার্যকর চাপ প্রয়োগ করছে না।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই হামলাকে “war crimes” (যুদ্ধ সন্ত্রাস) হিসেবে অভিহিত করেছে এবং স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিক্রিয়া: জবাবহীনতা নাকি রাজনীতি?
জাতিসংঘ একাধিকবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব এনেছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বারবার ভেটো দিয়েছে।

ওয়াসিংটন পোস্ট লিখেছে, “এই সংঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে মানবাধিকারের কথা বলছে, অন্যদিকে ইসরায়েলের সামরিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে।”

অন্যদিকে জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ ইসরায়েলের পাশে অবস্থান নিয়েছে। তবে ফ্রান্স ও আয়ারল্যান্ডের মতো কয়েকটি দেশ যুদ্ধবিরতির পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে।

বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ ও এক নতুন সংহতির ভাষা
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি শহরে—নিউইয়র্ক, লন্ডন, টোকিও, জাকার্তা, কায়রো, ঢাকা, ইসলামাবাদ, কেপ টাউন—ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়, বুদ্ধিজীবী, সেলিব্রিটি থেকে শুরু করে ধর্মীয় নেতারা পর্যন্ত এই আক্রমণের বিরোধিতা করেছেন। “Ceasefire Now” বা ‘এখনি যুদ্ধ বন্ধ করো’ শ্লোগান ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।

বিশ্লেষণ: রাজনৈতিক দ্বৈতনীতি ও নৈতিক দায়িত্ব
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং মাঠের চিত্র বিশ্লেষণ করলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে—
১.একটি রাষ্ট্রের আত্মরক্ষা কতদূর পর্যন্ত বৈধ?
২.বেসামরিক মানুষের মৃত্যু কি 'Collateral Damage' বলে এড়িয়ে যাওয়া যায়?
৩.পশ্চিমা গণমাধ্যম কি এখনও রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাবের বাইরে যেতে পেরেছে?
৪.মানবতার প্রশ্নে বিশ্ব কি আর একমত হতে পারছে না?
এই প্রশ্নগুলো আজ বিবেককে নাড়া দিচ্ছে।

ধ্বংসের চিত্র নয়, নৈতিক চেতনার বিপর্যয়
মৃত্যু, ধ্বংস, আর্তনাদের ভূখণ্ড ফিলিস্তিন শুধু একটি জাতির নাম নয়—এটি একটি প্রতীক, যেখানে প্রতিদিন একটি জাতি অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই লড়াইয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নিরব বিশ্ব, দ্বৈত নীতির শিকার গণমাধ্যম এবং ধুয়াশাময় রাজনীতি।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের অনেকে সাহসিকতার সঙ্গে সত্য তুলে ধরলেও, সব সময় তারা নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারছে না। কিছু কিছু গণমাধ্যম সাহসিকতার পরিচয় দিলেও অনেকেই নৈতিক প্রশ্ন এড়িয়ে চলেছে। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর নির্লিপ্ততা বিশ্ব বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সত্য এখন শুধুই রিপোর্টে সীমাবদ্ধ—পদক্ষেপে নয়। গাজার আকাশে ধোঁয়া, কিন্তু পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যেন তা দেখতে পায় না, বা দেখতে চায় না।

নিউজবাংলাদেশ.কম/এনডি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়