ধর্মনিরপেক্ষতা-সমাজতন্ত্র দ্বন্দ্বে মুখোমুখি অবস্থানে বাম-ডান

ছবি: সংগৃহীত
বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির মধ্যে দুটি—ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র—নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে স্পষ্ট বিভাজন দেখা দিয়েছে। জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র নিয়ে আপাতত বিতর্ক না থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সংশোধনের প্রস্তাব ঘিরে ডান ও বাম রাজনৈতিক দলগুলো দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
বুধবার (২৫ জুন) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ছয় দিনের ধারাবাহিক আলোচনার ষষ্ঠ দিনে, রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে অনুষ্ঠিত মধ্যাহ্ন বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব অবস্থান তুলে ধরেন।
বৈঠক-পরবর্তী সাংবাদিক ব্রিফিং ও দলীয় বিবৃতিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, একটি অংশ সংবিধানে “ধর্মীয় মূল্যবোধ” ও “সাম্যের” মতো ধারণা সংযোজনের পক্ষে মত দিয়েছে, অন্য অংশ ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার প্রতি অটল থাকার বার্তা দিয়েছে।
সংশোধনের পক্ষে থাকা দলের অবস্থান
১. জামায়াতে ইসলামী
নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। তাই সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ এবং ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করতে হবে। সমাজতন্ত্রের স্থলে ‘সাম্য ও মানবিক মর্যাদা’ থাকতে হবে।
তার মতে, সিপিবি ও দুই-একটি বাম দল ছাড়া অধিকাংশ দল এ প্রস্তাবে একমত।
২. জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ
মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর বক্তব্য, সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে সাম্য ও মানবিক মর্যাদার কথা সংযোজন করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ধর্মীয় মূল্যবোধ উল্লেখ করা উচিত।
৩. বাংলাদেশ লেবার পার্টি
চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান দাবি করেন, ৫ আগস্টেই ৭২-এর সংবিধানের কবর রচিত হয়েছে।
তার মতে, এই সংবিধান জনগণ চায় না।
তিনি অভিযোগ করেন, ঐকমত্য কমিশন কয়েকটি বাম দলকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রাধান্য দিচ্ছে।
৪. এবি পার্টি (আমার বাংলাদেশ পার্টি)
সরাসরি পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান না নিলেও ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় “ধর্মীয় বিষয়ে পক্ষপাতহীনতা”র কথা বলেছে।
৫. অন্যান্য সমমত পোষণকারী দল
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দল সংবিধান সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছে বা সংশোধনী আলোচনায় অংশ নিচ্ছে।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ ১০ বছর, শর্তসাপেক্ষে একমত বিএনপি
সংশোধনের বিপক্ষে থাকা দলের অবস্থান
১. বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত মূলনীতি পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। তবে বিদ্যমান চারটি মূলনীতি অক্ষুণ্ণ রেখে প্রস্তাবিত নতুন বিষয় যুক্ত করার পক্ষপাতী আমরা। একমত না হলে জনগণের রায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানাই।
২. বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, যেহেতু বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই এটি নিয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন। চটজলদি সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী।
৩. বাসদ ও গণসংহতি আন্দোলন
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ এবং গণসংহতির প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকিও চার মূলনীতির পরিবর্তনের বিপক্ষে অবস্থান জানান।
৪. বাংলাদেশ এলডিপি
মহাসচিব শাহাদাৎ হোসেন সেলিম অভিযোগ করেন, ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকগুলো কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এভাবে চললে জুলাইতেও কাজ শেষ হবে না।
দ্বিধান্বিত বা মন্তব্য বর্জনকারী দল
বিএনপি ও এনসিপি (ন্যাশনাল কনজারভেটিভ পার্টি)
দুটি বড় দল এখনও পর্যন্ত সংবিধানের দুটি মূলনীতি সংশোধন বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত মন্তব্য প্রকাশ করেনি।
তবে বিএনপির কয়েকজন নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন, এখনো দলীয় অবস্থান নির্ধারণ হয়নি। কমিশনের আলোচনার গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আলোচনায় অংশ নেওয়া একাধিক দলের অভিযোগ, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এখনও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ধারাবাহিকভাবে এই ব্যর্থতা আলোচনাকে অনিশ্চিত করে তুলছে।
কমিশনের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিটি বিষয়েই দলগুলো ভিন্নমত থাকায় মূলনীতির পরিবর্তন বা সংশোধনে এগোনো যাচ্ছে না। জুলাই মাসে চূড়ান্ত সুপারিশ প্রস্তাবনা দেওয়ার লক্ষ্য থাকলেও তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে সামরিক ও রাজনৈতিক নানা কারণে এ চারটি মূলনীতির ওপর বারবার আঘাত আসে। ২০১১ সালের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে চারটি মূলনীতিই আবার সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়। তবে এবার রাজনৈতিকভাবে নতুন করে বিভাজনের রেখা তৈরি হয়েছে, যা সংবিধান সংশোধনের দিক নির্ধারণে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি