আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা বিদ্রোহের সঙ্কেত

ছবি: সংগৃহীত
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক সাফল্য এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এরা কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে সদস্য সংগ্রহ শুরু করেছে, যার ফলে সীমান্ত অঞ্চলে নিরাপত্তা উদ্বেগ যেমন বাড়ছে, তেমনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াও হুমকির মুখে পড়েছে।
বুধবার (১৮ জুন) প্রকাশিত আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (ICG) ‘বাংলাদেশ-মিয়ানমার: রোহিঙ্গা বিদ্রোহের ঝুঁকি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
২০২৪ সালের নভেম্বরে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে আরাকান আর্মির অগ্রগতির সময় রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো একটি মোড় পরিবর্তন করে। পূর্বের শত্রুতা ভুলে তারা আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের কক্সবাজারসহ বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে রিক্রুটমেন্ট অভিযান জোরদার হয়। ধর্মীয় আহ্বান এবং ‘জিহাদ’ ঘোষণার মতো বার্তা ব্যবহার করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমর্থন নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
আইসিজি জানায়, গত ডিসেম্বরেই মংডু টাউনশিপের পতনের মধ্য দিয়ে উত্তর রাখাইন প্রায় সম্পূর্ণভাবে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে আসে। তখন থেকেই রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো অবস্থান পাল্টাতে শুরু করে এবং শরণার্থীদের ‘ঘরে ফেরা’র একমাত্র উপায় হিসেবে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দেয়।
বাংলাদেশ সরকার আরাকান আর্মির প্রভাব মাথায় রেখে সীমান্তে অঘোষিত আলোচনা শুরু করেছে এবং সীমান্ত স্থিতিশীলতায় রাখাইনের সঙ্গে বাণিজ্য ও ত্রাণ সহায়তা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে।
আরও পড়ুন: ইসরায়েলের আকাশসীমা দখলের দাবি ইরানের
তবে ক্রাইসিস গ্রুপ আশঙ্কা করছে, যদি রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে যায়, তবে এই কূটনৈতিক প্রয়াস ব্যাহত হতে পারে। মিয়ানমারের জনগণের মধ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব আরও বাড়বে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া প্রায় অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে।
আইসিজি-এর মিয়ানমার ও বাংলাদেশবিষয়ক সিনিয়র কনসালট্যান্ট থমাস কিন বলেন, গত ছয় মাসে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ বন্ধ রেখে শরণার্থী শিবিরে সদস্য সংগ্রহে মনোনিবেশ করেছে। এই পথে অগ্রসর হলে সীমান্তের উভয় পাশে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়বে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষদের নিজেদের পক্ষের মিলিশিয়ায় রিক্রুট করার উদ্যোগ নেয়। অতীতে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো সেনাবাহিনীর বিরোধিতা করলেও এবার তারা আরাকান আর্মিকে ঠেকাতে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একধরনের সমঝোতায় যায়। সেনাবাহিনীর পক্ষে লড়াই করতে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে কাজ করে এবং রোহিঙ্গা যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়।
তবে এই কৌশল বড় সফলতা আনতে পারেনি। অনেক রোহিঙ্গা এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে। তদুপরি, আরাকান আর্মির দ্বারা নির্যাতনের অভিজ্ঞতা থাকায়, তাদের অনেকেই এখন আরাকান আর্মিকে সেনাবাহিনীর চেয়েও বড় হুমকি হিসেবে দেখছে।
আইসিজি-এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য তিনটি সুপারিশ দেওয়া হয়েছে:
আরাকান আর্মির সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ জোরদার
রাখাইনে বাণিজ্য ও সহায়তা বৃদ্ধি
শরণার্থী শিবিরে সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাব কমানো
অন্যদিকে আরাকান আর্মির প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, তারা যেন সব সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয় এবং প্রমাণ করে যে তারা সবাইকে নিয়ে শাসন চালাতে সক্ষম।
আন্তর্জাতিক দাতাদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে, তারা যেন বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা হ্রাস না করে বরং আরও বাড়ায়।
আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের লড়াই রাখাইনে আরও রক্তপাত ও জাতিগত সংঘাত বাড়াতে পারে। ফলে বাংলাদেশে আরেক দফা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আগমনের সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধাচরণে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন সংস্কারের প্রচেষ্টাও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির আধিপত্য যেমন সামরিক বাস্তবতা পাল্টে দিচ্ছে, তেমনি রোহিঙ্গা বিদ্রোহের সম্ভাবনা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ, রোহিঙ্গা গোষ্ঠী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, যোগাযোগ এবং কৌশলগত সমঝোতা গড়ে তোলা জরুরি, যাতে সামগ্রিক অঞ্চলে সংঘাত না বাড়ে এবং প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা পুরোপুরি নষ্ট না হয়।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি