অঘোষিত দখলে নগর ভবন, নাগরিক দুর্ভোগ

ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে (ডিএসসিসি) বর্তমানে এক নজিরবিহীন অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন শপথ গ্রহণ না করেই ‘মেয়র’ হিসেবে নগর ভবনের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন—এমন অভিযোগ ও বিতর্কের মধ্যেই নাগরিক সেবা কার্যক্রম এক মাসেরও বেশি সময় ধরে স্থবির হয়ে পড়েছে।
গত ১৫ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত ডিএসসিসি নগর ভবনের সব ধরনের নাগরিক সেবা বন্ধ ছিল। নগর ভবনের মূল ফটক ইশরাকপন্থী কর্মচারীরা আটকে রাখেন এবং প্রতিটি বিভাগে তালা ঝুলিয়ে দেন। এতে জন্মনিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, রাস্তা মেরামত, সড়কবাতি সংস্কারসহ মোট ২৮ ধরনের নাগরিক সেবা বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিদিন প্রায় ৫-৭ হাজার নাগরিক এসব সেবা নিতে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান।
আজিমপুরের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান জানান, বাচ্চার জন্মনিবন্ধন না হওয়ায় বিদেশে চিকিৎসা করাতে পারছি না।
বকশিবাজারের ব্যবসায়ী খোরশেদ আলম বলেন, ট্রেড লাইসেন্স ঝুলে থাকায় ব্যবসা শুরু করতে পারছি না।
ঈদের বিরতির পর ১৫ জুন থেকে ইশরাকপন্থীরা আবার নগর ভবনে জড়ো হয়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। ওইদিন নগর ভবনের কনফারেন্স রুমে একটি সভা করেন ইশরাক হোসেন, যেখানে তাকে ‘মাননীয় মেয়র’ উল্লেখ করে ব্যানার টানানো হয়।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি বলেন, এই আন্দোলন চলবে, সংবিধান লঙ্ঘনকারী স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার তত্ত্বাবধানে এই বিষয়টি দেখা উচিত। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বুধবার (১৮ জুন) ৭০টি ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক ও সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করে মশক নিধন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন ইশরাক হোসেন। এরপর তিনি দক্ষিণ সিটির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সভা করেন।
সেখানে তিনি বলেন, সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে ঢাকাবাসীর ভোগান্তি সৃষ্টি করছে। চলমান আন্দোলনের পাশাপাশি সেবাও চালু রাখতে হবে।
আরও পড়ুন: ইশরাকের কর্মকাণ্ড স্পষ্ট আইন লঙ্ঘন: উপদেষ্টা আসিফ
ডিএসসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অভিযোগ করেন, ইশরাকের নির্দেশ বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্তা ব্যক্তিরা বাধা দিচ্ছেন যাতে আন্দোলনের ব্যর্থতা ইশরাকের ওপর চাপানো যায়। তবু তারা সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে কিছু সেবা সচল রেখেছেন।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ১৮ জুন জানান, ডিএসসিসির মেয়র ও কাউন্সিলরদের মেয়াদ শেষ হয়েছে, ফলে নতুনদের শপথ নেওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, গেজেট প্রকাশে বিলম্ব এবং পরে গেজেটের অকার্যকারিতার কারণে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত বিভ্রান্তিকর হয়েছে। আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণের কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, এখন কর্পোরেশনের অফিসগুলো এক প্রকার দখলে চলে গেছে। ফলে আমরা সেবা দিতে পারছি না। আইন উপদেষ্টার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, গেজেট কার্যকর হলেও ২০ দিন আগে সেটি অকার্যকর হয়ে গেছে এবং আইনগতভাবে শপথ সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, জোর করে নিজের তত্ত্বাবধানে নগর ভবনের কার্যক্রম পরিচালনার দৃষ্টান্ত একটি খারাপ উদাহরণ। দিনের পর দিন নাগরিক ভোগান্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় ইশরাক বলেন, চলমান আন্দোলনের পক্ষে অবস্থানকারীদের ওপর ফ্যাসিস্ট হাসিনার মতো আচরণ করা হলে আমি সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করবো।
তিনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আপনাদের পাশে থাকবো, ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকুন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন সাবেক সচিব ও আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক মশিউর রহমান, সাবেক কাউন্সিলর মকবুল হোসেন খান টিপু, মো. মোহন, মো. রফিক, মো. মামুন আহমেদ, সুরাইয়া বেগম, সামসুল হুদা কাজলসহ স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মচারী।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এখন এক গভীর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংকটে রয়েছে। একদিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে কার্যভার গ্রহণের চেষ্টা, অন্যদিকে সরকারি আইনগত জটিলতা—উভয় পক্ষের অবস্থানে সাধারণ নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়ে উঠেছেন।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি