ইতালির পথে নিখোঁজ বরিশালের ৩৮ যুবক এখন লিবিয়ার কারাগারে
ছবি: সংগৃহীত
ইউরোপে স্বপ্নের জীবনের খোঁজে লিবিয়ার উপকূল বেনগাজী থেকে সাগরপথে গেমিং বোটে (নৌকা) ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে নিখোঁজ হওয়া বরিশালের গৌরনদী উপজেলার ৩৮ জন যুবকের সন্ধান মিলেছে। দীর্ঘ এগারোদিন ধরে তাদের কোনো খোঁজ না পেয়ে পরিবারে নেমে আসে চরম হতাশা ও কান্নার রোল। অবশেষে ১৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে লিবিয়ার কোস্ট গার্ড তাদের আটক করে গাম্মুদা কারাগারে সোপর্দ করে। একইসাথে আরও ৩২ জন বাংলাদেশিকেও আটক করা হয়, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ঢাকা, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার বাসিন্দা।
নিখোঁজ যুবকরা চলতি বছরের ২৩ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে ওমরা হজ ভিসায় সৌদি আরবে যান। সেখান থেকে মানব পাচারকারী দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চোরাই পথে লিবিয়ায় প্রবেশ করেন। ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেও এরপর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
সূত্র মতে, প্রত্যেক যুবক তাদের সহায়-সম্বল বিক্রি করে ও ধারদেনা করে ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত তুলে দেন দালালদের হাতে। এই অর্থের বিনিময়ে তারা অবৈধভাবে গেমিং বোটে ইতালি যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। ৯ সেপ্টেম্বর রাত ১টার দিকে বেনগাজী উপকূল থেকে যাত্রা শুরু হয়, যা পরিণত হয় এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে।
যাত্রাপথে লিবিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গেমিং বোটটি আটক করে। পরে ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে ৭০ জন বাংলাদেশিকে গাম্মুদা কারাগারে পাঠানো হয়।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ইতালি প্রবাসী বরিশালের গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের জামাল মোল্লার ছেলে জাকির হোসেন মোল্লা দালাল চক্রের বিভিন্ন এজেন্টদের মাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন যে, নিখোঁজ যুবকরা লিবিয়ার জেলখানায় আটক রয়েছেন।
জাকির হোসেন আরও জানান, একইদিন রাতে ওই ৩৮ জনের গেমিং নৌকার পাশাপাশি লিবিয়ার উপকূল বেনগাজী থেকে আরেকটি নৌকায় থাকা ৩২ জন বাংলাদেশিকেও লিবিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করেছে। ৩৮ জন যুবকের মধ্যে জাকিরের স্বজনও রয়েছেন।
জাকিরের বোন তানিয়া আক্তার জানান, তার ভাই যেকোনো উপায়ে যুবকদের মুক্ত করতে দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
লিবিয়ার কারাগারে থাকা যুবকদের স্বজনরা জানান, নাম প্রকাশ না করার শর্তে, তারা সকলেই গৌরনদীর বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে পরিচয় পাওয়া যায় নিম্নলিখিতদের:
বার্থী গ্রাম: মো. আমিনুল ইসলাম, রহিম হাওলাদার, মো. অহিদুল হাওলাদার, সুজন খান, সবুজ মোল্লা
বড় দুলালী গ্রাম: রাহুল সরদার, শাহ আলী বয়াতী, বাবুল বেপারী, তানভির হোসেন হৃদয়, মাসুদ তালুকদার, রাব্বী সরদার, রিয়াজুল বেপারী, বিপুল সরকার, শাহাদাত সিকদার, মো. রিমন মীর, তৌহিদ হাসান হৃদয়
- উত্তর বাউরগাতী গ্রাম: ফাহিম প্যাদা, ইব্রাহীম প্যাদা, শামিম সরদার
- তাঁরাকুপি গ্রাম: মুন্না বয়াতী
- উত্তর মাদ্রা গ্রাম: শান্ত দত্ত
- বাঙ্গিলা গ্রাম: সুমন কাজী
- পূর্ব ডুমুরিয়া গ্রাম: কামরুল বেপারী
- ছোট ডুমুরিয়া গ্রাম: মেহেদী হোসেন খান
- পশ্চিম ডুমুরিয়া গ্রাম: বাবুল মোল্লা
- পূর্ব সমরসিংহ গ্রাম: আবুবক্কর মোল্লা
- উত্তর মাগুরা: সাদ্দাম বেপারী
- আগৈলঝাড়া: আলী হোসেন বেপারী
- মাদারীপুর, ডাসার উপজেলা: সজিব বেপারী
- কালকিনি: ফারহান হোসেন জয়
এক যুবকের বিধবা মা নাজমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার ছেলে বলেছিল মা, জীবনে অনেক কষ্ট করেছো, আর কষ্ট করতে হবে না। এখন আমার বুকের মানিক কোথায় আছে, কেমন আছে জানি না। অনেক কষ্ট করে সহায়-সম্বল বিক্রিসহ ধারদেনা করে ছেলে তার স্বপ্নপূরণ করতে চেয়েছিল।”
স্থানীয় মানবপাচার চক্রের এজেন্টরা জানান, গাম্মুদা কারাগারে ১৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে নিখোঁজ ৩৮ জনসহ মোট ৭০ বাংলাদেশি আটক করা হয়েছে। আটক যুবকদের মধ্যে ৫০ জনই গৌরনদীর খাঞ্জাপুর ও বার্থী ইউনিয়নের বাসিন্দা এবং বাকিরা ঢাকা, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের বিভিন্ন গ্রামের।
এজেন্টরা আরও জানান, আটক ৭০ জনকে কারাগার থেকে পর্যায়ক্রমে মুক্ত করার চেষ্টা চলছে এবং মুক্তি পাওয়ার পর পরিবারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করানো হবে।
গৌরনদী থানার ওসি তারিকুল ইসলাম বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি দেখেছি। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত সাপেক্ষে মানব পাচারকারী দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, ইউরোপে স্বপ্ন দেখার চাপে বহু যুবক মানবপাচার চক্রের জালে ফসছে এবং অর্থনৈতিক কষ্টে পরিবারগুলি অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়ছে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








