দেশে ৭০ সালের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে শীত
ছবি: সংগৃহীত
ভবিষ্যতে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিস্থিতি গতানুগতিক সীমা ছাড়িয়ে বড় ধরনের পরিবর্তনের মুখে পড়তে পারে, সতর্ক করেছেন আবহাওয়াবিদরা। বিশেষ করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ অব্যাহত থাকলে ২০৪১ থেকে ২০৭০ সালের মধ্যে দেশের গড় তাপমাত্রা আরও ১–২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শতাব্দীর শেষে এই বৃদ্ধি দেড় থেকে সাড়ে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এতে দেশের অর্থনীতি, কৃষি এবং মানুষের জীবনযাত্রার ওপর বড় চাপ তৈরি হবে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও নরওয়েজিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট যৌথভাবে ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ুর রিপোর্ট-২০২৫’ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে আগামী সাত থেকে আট দশকে দেশের জলবায়ুর পাঁচটি সম্ভাব্য পরিস্থিতির বিশদ বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে। রিপোর্টটি উপস্থাপন করেন আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রীষ্মকালে তাপপ্রবাহ আরও ঘন ঘন ও দীর্ঘকালীন হবে। বিশেষত মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বর্ষার আগে তাপপ্রবাহ সর্বাধিক থাকবে। পশ্চিমাঞ্চলে ২০৭০ সালের মধ্যে বর্ষার আগের ২০ দিন পর্যন্ত তাপপ্রবাহ চলতে পারে, যা বর্তমানের তুলনায় ৭৫ শতাংশ বেশি। বর্ষাকালেও তাপপ্রবাহ তিন গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
রাজধানী ঢাকার জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী বছরগুলোতে ঢাকাবাসী বছরে অন্তত দুটি তীব্র তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হবেন– একটি বর্ষার আগে, আরেকটি অক্টোবর–নভেম্বর মাসে। দিনের তাপমাত্রা ৪.৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনাকে ‘সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি’ হিসেবে ধরা হয়েছে।
আরও পড়ুন: ঢাকায় ২৮ বছরে সবুজ ও ফাঁকা জায়গা কমেছে ২৯ কি.মি.
শীতকালের ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন ঘটবে। যদিও উত্তর, পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কিছু শৈত্যপ্রবাহ থাকবে, উপকূলীয় অঞ্চলে শীত ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাবে। শতাব্দীর শেষে শীতকাল প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। ডিসেম্বর–জানুয়ারির মধ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু জেলায় মাত্র এক-দুই দিনের মৃদু বা মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ দেখা দেবে।
বৃষ্টিপাতের ধরনেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে পারে। বাংলাদেশে মোট বৃষ্টির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ বর্ষাকালে হয়।
গবেষণার তথ্যমতে, ২০৭০ সালের মধ্যে বর্ষার গড় বৃষ্টি ১১৮ মিলিমিটার বৃদ্ধি পাবে। ২১০০ সালে এই বৃদ্ধি ২৫৫ মিলিমিটার পর্যন্ত পৌঁছাবে। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, যা অতিবৃষ্টি, বন্যা এবং ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়াবে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাপী যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বছরে গড়ে ২.১ মিলিমিটার বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, বাংলাদেশের উপকূলে তা ৫.৮ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। শতাব্দীর শেষে দেশের উপকূলীয় এলাকার ১৮ শতাংশ স্থায়ীভাবে পানির নিচে চলে যেতে পারে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে সুন্দরবনের ২৩ শতাংশ এলাকা পানিবদ্ধ হতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
জলবায়ুর এই পরিবর্তন কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ফসলের উৎপাদন কমে যাবে, গবাদিপশুর রোগবালাই বাড়বে এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে মাছের আবাস ও মিঠাপানির উৎস সংকুচিত হবে। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি বেড়ে যাবে। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, কলেরা ও পানিবাহিত রোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। উচ্চ তাপমাত্রায় শ্রমিকদের বাইরে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং তাপজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে।
প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে বজলুর রশিদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন হঠাৎ থেমে যাবে না, তাই প্রস্তুতি দীর্ঘমেয়াদি হতে হবে। নিঃসরণ কমানোর পাশাপাশি উপকূলে সুরক্ষা অবকাঠামো জোরদার, বাঁধ নির্মাণ, আশ্রয়কেন্দ্র বৃদ্ধি এবং আধুনিক আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হ্যাকন অ্যারাল্ড গুলব্র্যান্ডসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর শুধুমাত্র পরিবেশগত সমস্যা নয়। এটি কৃষি, জনস্বাস্থ্য, নগরায়ণ এবং জ্বালানি খাতকে প্রভাবিত করছে। সমাধানে সব খাতের সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য।
২০১১ সাল থেকে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও নরওয়েজিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট একসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে কাজ করছে। ২০২৫ সালের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে তারা তাদের তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রকাশ করল।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








