সংস্কারের সরণিতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ

ছবি: সংগৃহীত
আজ ১৫ মে, উনিশ শতকের অন্যতম মহান সমাজ ও ধর্মসংস্কারক, দার্শনিক এবং ব্রাহ্মধর্মের অগ্রদূত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। এই দিনে, ১৮১৭ সালের ১৫ মে (৩ জ্যৈষ্ঠ, ১২২৪ বঙ্গাব্দ), কলকাতার ঐতিহাসিক জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন এক ভবিষ্যৎ ভাবুক, যিনি শুধুমাত্র ঠাকুরবাড়ির নয়—সমগ্র ভারতবর্ষের ধর্মীয় ও নৈতিক ভাবনার গতিপথ পরিবর্তন করেছিলেন।
দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন স্রেফ কোনো অভিজাত পরিবারের সন্তান নয়; তিনি ছিলেন এক অনুসন্ধিৎসু মন। তার পিতা দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রগতিশীল চিন্তার পাশাপাশি তিনি আত্মস্থ করেছিলেন আত্মানুসন্ধানের এক অভ্যন্তরীণ আহ্বান। কৈশোরে অ্যাংলো-হিন্দু স্কুলে পড়াশোনা এবং পরে বাবার প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন ব্যাংকে কাজ শুরু করলেও আত্মা শান্তি খুঁজেছিল উপনিষদে।
১৮৩৮ সালে তার পিতামহীর মৃত্যুর পর, তিনি গভীরভাবে ভারতীয় ও ইউরোপীয় দর্শনে মনোনিবেশ করেন। এই সময়ই তিনি উপনিষদ চর্চার মাধ্যমে এক আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠেন। তার নেতৃত্বেই শুরু হয় ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ এবং পরে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা প্রকাশ—যা ব্রাহ্মচিন্তার মূর্তরূপ হয়ে ওঠে।
দেবেন্দ্রনাথের চিন্তা ছিল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার ঊর্ধ্বে, এক গভীর মানবিকতাবাদে উদ্ভাসিত। ১৮৪৩ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন এবং তার ২১ জন আত্মীয়কে সঙ্গী করেন এই ধর্মযাত্রায়। এ সিদ্ধান্ত তার পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে এক তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এনে দেয়। অনেকে তাকে ত্যাগ করলেও, তিনি ছিলেন আপসহীন এক অনুসন্ধানী আত্মা।
বিধবাবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহ বিরোধিতা তার চিন্তার প্রাক-আধুনিক বলয়ে এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত। ১৮৬৭ সালে ব্রাহ্মসমাজ তাকে ‘মহর্ষি’ উপাধিতে ভূষিত করে—এটি কেবল একটি সম্মান নয়, তার কর্ম ও দর্শনের প্রতি সমাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
সমাজ সংস্কারে একসময় ঘনিষ্ঠ সঙ্গী কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে মতবিরোধের পর, দেবেন্দ্রনাথ ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’ গঠন করেন। এটি কেবল একটি সংগঠন বিভাজন নয়, বরং ধর্মচিন্তার ভিন্নতা ও ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতার এক স্পষ্ট স্বাক্ষর। তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে সক্রিয় ভূমিকা থেকে সরিয়ে নেন, কিন্তু তার আদর্শ ও দর্শন থেকে নয়।
দেবেন্দ্রনাথ শুধু ধর্মভাবনার পুরোধা ছিলেন না; তিনি ছিলেন ভবিষ্যৎ বিশ্বকবির পিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কাছে শুধু একটি পারিবারিক নাম নয়, বরং ছিল সংস্কৃতি ও মানবতার উত্তরাধিকার। দেবেন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব ও দর্শন রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় সুগভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি (৬ মাঘ ১৩১১ বঙ্গাব্দ), ৮৮ বছর বয়সে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরবিদায় নেন। তবে তিনি রেখে যান এক উদ্ভাসিত পথ—যা আজও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, আত্মানুসন্ধান ও মানবিকতার অনন্য নিদর্শন হয়ে আছে।
আজ যখন আমরা ধর্মীয় মেরুকরণ, সমাজ বিভাজন ও চেতনার সংকোচনের সময় পার করছি, তখন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও ভাবনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আত্মসচেতনতা, উদারতা এবং সত্যানুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা। তার জন্মদিন কেবল একটি তারিখ নয়—এটি এক অবিনাশী আলোয় ফেরার দিন।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি