যশোরে `বর্ষবরণ শোভাযাত্রা` ইউনেস্কো হেরিটেজে’ যেভাবে স্থান পায়

ছবি: সংগৃহীত
আদি বাংলায় অগ্রহায়ণকেই বছরের সূচনা মাস ধরা হতো। বাদশা আকবর ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গাব্দ প্রচলন করেন। যার প্রথম মাস ছিল বৈশাখ। তারপর থেকে পহেলা বৈশাখকে বাংলা নববর্ষ ধরা হয়। তাকে ঘিরে হালখাতা, বৈশাখি মেলা, আরো কতো উৎসব চলে আসছে।
এর মধ্যে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অবশেষে স্বাধীন বাঙালির জীবনে এলো হারানো সব শিল্প ঐতিহ্যের রঙিন রূপেলা প্রাণোচ্ছল আশ্চর্য সুন্দর " বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা"। আজ সেটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎসব হয়ে উঠেছে। বাঙালির এই আনন্দ শোভাযাত্রা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো স্বীকৃতিও প্রদান করেছেন।
বাঙালীর এই আনন্দ বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" প্রধান উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী জামাল শামীমের সাথে মঙ্গল শোভাযাত্রার আদ্যপ্রান্ত নিয়ে কথা বলে জানা গেছে, তিনি ২০৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি শেষ হতেই মনে করেন সমগ্র বাংলাদেশটিই একটা ক্যানভাস। সবাই মিলে মনের মত করে তাকে আঁকতে হবে।
পূর্বসূরী জয়নুল, সুলতানের রিলেরেসের কাঠি হাতে আরেকটি প্রজন্মের শিল্পের সমাজ গঠনের ছুট শুরু করেছিলেন । এবার সমগ্র বাংলাদেশে শিল্পচর্চা ও গবেষণার প্রসার ঘটিয়ে মানবজীবনের উন্নয়ন ও উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে ১৯৮৪ সালে চারুপীঠ আর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিয়েছিলেন। রাজধানীমুখীতার বিপরীতে সমস্ত দেশের জন্য প্রতীকীভাবে বেছে নেয়া হয় দেশের একটি জেলা শহর। মহান শিল্পী এস এম সুলতানের কর্ষিত ভূমি মাহবুব জামাল শামীমের জন্মভূমি যশোরেই হলো প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়।
ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান, শিল্পী শিশির ভট্টচার্য, ভাস্কর লালারুখ সেলিম, ছাপচিত্রি মোকলেসুর রহমান, চিত্রকর হিরন্ময় চন্দ, আমি এবং যশোরের অগণিত শিল্পপ্রেমী মহাপ্রাণ মানুষ ও জেলা প্রশাসক আব্দুল মুক্তাদির চৌধুরীকে নিয়ে চারুপীঠের পথ চলা শুরু করেছিলাম। স্বাধীন বাঙালি জাতির রূপস্রষ্টা মহান শিল্পী এস. এম. সুলতান আমৃত্যু প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়েছিলেন।
বাংলা বর্ষবরণে আনন্দ শোভাযাত্রা উদ্ভাবন ও প্রচলনের গল্প
চারুপীঠের সূচনার একটি সার্থক কর্মসূচি বাঙালির রাজসিক ঐতিহ্য উৎসব "বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা"। সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর মাঝে শিল্প ও ঐতিহ্যের চর্চার আনন্দতম কর্মব্যস্ততা সৃষ্টির পথ নির্মাণের কাজ ছিলো এটা। সময়টা ছিল বাংলা ১৩৯২ সন, ইংরেজি ১৯৮৫ সাল। বাঙালি মুসলমান সমাজে তখন নাচতে বারণ, গাইতে বারণ, আঁকতে বারণ ,ভাস্কর্য গড়তে বারণ, প্রাণ খুলে হাসতে বারণ। এ জাতি স্বাধীনতা পেয়েও গুণহীনতা আর জড়তায় বন্দী । তাই সব শিল্পের সমন্বয়ে প্রাণখোলা উৎসব সৃষ্টি করে সমাজ জীবনকে এক ঝটকায় মুক্ত করে দেওয়া হলো। শিল্প ঐতিহ্যের সব অনুষঙ্গ সব বাঙালির নিজের করে নেয়া হলো। তারুণ্যের রক্তে গড়া ২১'এর পথ ধরে আমাদের ভাষা স্বাধীনতা। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান সবার মিলন। ২১'এর প্রভাতফেরীকেই যেন ঐতিহ্যের সব রঙে-রূপে সাজিয়ে ঢাক-ঢোল, সানাই- কাসী, ঝাঝরির উন্মাদনায় নাচিয়ে স্বাধীন বাঙালির জীবনে চির পুরাতনকে নিয়ে অভিনব রাজসিক উৎসব "বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" রচনা করা হয়েছিল।
ব্রাহ্মণ্যবাদের নিষ্পেষণ, সামন্ত যুগ ও ঔপনিবেশিক যুগের দুষ্ট মননের শাসন চলেছে হাজার বছর ধরে। অন্নদাতা কৃষককুল আর আমাদের গার্হস্থ্য জীবনের প্রতিটা প্রয়োজনীয় সামগ্রী, পাত্র ,আসবাবপত্র, পোশাক, স্থাপত্যে, জল-স্থলের যানবাহনের কারুকার্যে, শিশুর মনোরঞ্জনের খেলনা-পুতুল, সব কিছুরই নির্মাণে, রূপে,গড়নে, রঙে রাঙিয়ে জীবনকে উপভোগ্য করে এসেছেন আমাদের লোকজ শিল্পীকুল। বহমান সমাজের রুচির নির্মাতা, তারই। তারা সবাই গ্রামবাসী। এই নগর তাদেরকে প্রাপ্য অর্থ এবং মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেছে এবং অসম্মানের পাত্র বিবেচনা করে এসেছে। নিগৃহীত পঁচানব্বই ভাগ গ্রাম্য মানুষের মাঝে লালিত দেশজ কৃষ্টি। তাকেই আজ আমরা আদরে নয়ন মেলে দেখছি। শিল্প মর্যাদায় অনুভব করছি । তারই প্রাণবন্ত অথৈ জলের ধারা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের নগরের মাঝ দিয়ে মৃত্তিকা ভেঙ্গে যেন নদী হয়ে আশ্চর্য সুন্দর দেশজ কৃষ্টির এই রাজসিক উৎসব 'বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা"' বহমান হয়েছে। সগৌরবে মিলেছে সভ্যতার মহাসাগরে।
ফিরে যাই বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" সূচনার দিনগুলোতে। নব্য চারুপীঠের আঁকিয়ে শিশুরা একুশের প্রভাতফেরীতে রঙিন বর্ণমালা ফুল-পাখি- প্রজাপতি নিয়ে প্রাণবন্ত রঙরূপে সেজে অংশ নিলো। সেখানে সবার সুখ্যাতি পেয়ে ভারি উচ্ছ্বসিত হয়ে ফিরে শিল্পী হিরন্ময় চন্দ বললে, "শামিম ভাই, এর পরেই আসছে পহেলা বৈশাখ, আমরা কী করবো?" উত্তরে বলেছিলাম, "একুশের প্রভাতফেরী যেমন বাঙালির ভাষার বিজয় শোভাযাত্রা, পহেলা বৈশাখের প্রভাতকেও তেমনি বাঙালির কৃষ্টির বিজয় শোভাযাত্রায় রূপ দিতে হবে। দু'মাসেরও কম সময় হাতে আছে।" ঐদিনই হিরন্ময় চন্দ একদল শিল্পী নিয়ে রাজসিক মুকুট আঁকতে বসলো। আমি হিরন্ময় চন্দ কে প্রশ্ন করলাম "উৎসবে মুকুটের অর্থবহতা সম্পর্কে বলো।" ও বললো, "মুকুট পরলেই সবাই রাজা, রানী, রাজপুত্র, রাজকন্যা হয়ে যায়।" "খুব ভালো বলেছো, আমাদের এই 'সবাই রাজা'র দেশের উৎসবে অংশগ্রহণকারী সবাই নায়ক-নায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী, নর্তক-নর্তকী, আবার দর্শকও তারাই। সবাই একই সমান্তরালে। সমাজের সবাই শিল্পচর্চায় শামিল হলে নতুন মাত্রা পাবে এ উৎসব।" ছোট্ট শামিমুর রহমান একুশের জন্য ফুল, প্রজাপতি, পাখি, পরী বানিয়ে আমাদের অবাক করে দিয়েছে। ওকে বললাম, "তোমার তৈরি করা সব উপকরণই বৈশাখে ব্যবহার করবো। এসো এবার আমরা আরো অনেক লোকজ জিনিস তৈরি করি, কর্মী দল গঠন কর"।
কাদামাটি তৈরি করে মুখোশের ডাইস নির্মাণে বসলাম। একটি দলকে পেপার পেস্টিং বুঝিয়ে মুখোশ তৈরির দায়িত্ব দিলাম। হিরন্ময় চন্দ প্রশ্ন করলো, "উৎসবে মুখোশের অর্থবহতা কী হবে সে সম্পর্কে বলুন।" বললাম, "আমাদের সুন্দরবনে মৌয়ালরা ও গোলপাতা কাঠ সংগ্রহকারীরা বাঘের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার্থে মুখের পেছনে মুখোশ পরে বনে প্রবেশ করে। বাঘের স্বভাব সে পেছন থেকে আক্রমণ করবে। তাকে বোকা বানিয়ে ওদের জীবন-জীবিকা। বন থেকে ফিরে এলে তখন মুখোশগুলো শিশুদের কৌতুক- তামাশার আনন্দ করার সামগ্রী। আমাদের সাতক্ষীরায় গাজী-কালু-বনবিবির মুখোশ যাত্রাপালার আশ্চর্য সুন্দর শিল্পমানের মুখোশ-ঐতিহ্য রয়েছে। যশোরের শালিখার শোলা শিল্পেরও মুখোশ-ঐতিহ্য রয়েছে।
আমাদের এ আনন্দ শোভাযাত্রায় মানুষ ও নানা প্রাণীর মুখের সুন্দর, ভয়ঙ্কর, কৌতুককর অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলবো মুখোশে। মুখোশে ভাস্কর্যের ত্রিমাত্রিক গঠনের উপর উজ্জ্বল রঙে জ্যামিতিক চিত্রকলার ধারা গড়ে তুলবো। আমাদের ঐতিহ্যের মুখোশে বাঘ, দেও ,দৈত্য ভয়ঙ্কর, কৌতুককর, তামাশার বিষয় হয়ে থাকে। এটাই ভাস্কর্য আবার এটাই পেইন্টিং। বৈচিত্র্যময় মুখোশগুলো শোভাযাত্রার ওপরটা ত্রিমাত্রিক রঙিন অভিব্যক্তি দিয়ে উৎসবমুখর করে তুলবে।" এইভাবে ভাবনা-চিন্তা করে উৎসব গঠনের কাজ এগিয়ে নিচ্ছিলাম।
আমাদের এ উৎসবে সব শিল্প-ঐতিহ্যকে মিলাতে হবে তাই কর্মশালা জমে উঠতেই আমি শিল্পী শহিদুল ইসলামকে ঋষিপাড়ায় ঐতিহ্যের ঢাক-ঢোল আনতে পাঠালাম। চারুপীঠের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে লোকজ ঢাক-ঢোলের সাথে এক মাস ব্যাপী উৎসব নৃত্যের প্রশিক্ষণ শুরু করলাম। হিরন্ময় ও আমি শোভাযাত্রার ছেলেমেয়েদের নানা দলের উৎসব-পোশাকের নক্সা পরিকল্পনায় বসলাম। চিত্রকলা ও কবিতাকে বলা হয় একই অনুভূতির শিল্প। তাই হয়তো যশোর সাহিত্য পরিষদের পঞ্চাশজন তরুণ-তরুণী কবি-লেখক এই সূচনা বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" অংশ নিয়ে ইতিহাসে যুক্ত হয়েছিলেন।
দুই মাসের কর্মশালা করে মুকুট, মুখোশ, মনোমুগ্ধকর নানা উৎসব-উপকরণ, সাজ-পোশাক, নৃত্য, বাংলার লোকজ বাদ্য ঢাক-ঢোল, সব শিল্পকে মিলিয়ে, বাঙলা বর্ষবরণে চারুপীঠ উদ্ভাবিত দেশের প্রথম " বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা"" সৌন্দর্য ও অভিনবত্বে যশোর বাসিকে এমনই মুগ্ধ করেছিল, ফলশ্রুতিতে পরবর্তী বছর ১৯৮৬ সালে যশোরের তিরিশাধিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকেরা চারুপীঠ-এর সাথে সম্মিলিত হয়ে যশোরের দ্বিতীয় "বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" "কে বাঙালির বিরাট সামাজিক উৎসবে রূপদান সম্পন্ন করে ফেলে।
এই দ্বিতীয়বারের শোভাযাত্রার প্রস্তুতিতে চারুপীঠে চার মাস ব্যাপী কর্মশালায় রমরমা উৎসবের আমেজ চলতে থাকে শহরময়। এইভাবে চারুপীঠের ছাত্রছাত্রীদের দক্ষ শিল্পী, নক্সাবিদ, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কর্মী করে গড়ে তোলার বিরাট বন্দোবস্তের সূচনা হয়। সেই শোভাযাত্রা সুবৃহৎ হাতি, কুমির, লোকজ পুতুল, হাজার হাজার মুকুট, মুখোশ, ঐতিহ্যের শোলার পাখাসহ নানা রকমের উপকরণে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রঙিন ভাস্কর্য, চিত্রকলা, নক্সা শিল্প, পোশাক শিল্প, বাদ্য, নৃত্য, অভিনয়, কৌতুক, রঙ্গ-রসিকতা জীবনকে ভরপুর করলো। সাড়ে তিন হাজার সাজোয়া মানুষের সেই বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" যেন আন্তর্জাতিক উৎসবের রূপ পেয়েছিলো। ইতালিয় একজন চিত্রকর পুরোটা শোভাযাত্রা তার বিশাল ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ করছিলেন।
উৎসবের সাজে সেজে মুকুট পরে যশোরের মন্ত্রীদয় তরিকুল ইসলাম ও খালেদুর রহমান টিটোসহ বিমল রায় চৌধুরী এডভোকেট কাজী আব্দুস শহীদ লাল এবং গণ্যমান্যেরা আবেগপ্রবণ হয়ে বলেছিলেন, "এটা বাঙালির জাতীয় উৎসব হতে হবে।" ওরা এ উৎসবকে একটি শিল্প-বাণিজ্য সফল জাতি হয়ে ওঠার পরিপূরক সামাজিক চর্চা হিসেবেও গণ্য করেছিলেন।
পহেলা বৈশাখে যশোরের সকল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রভাতী অনুষ্ঠান শেষে ঈদের মতো আপ্যায়নের রেওয়াজ চলে আসছিলো। মায়েরা উৎসবের আনন্দে গভীর মমতায় দিন রাত জেগে কুলি, পাকান, পাটিসাপটা, নারকেল নাড়ু, মুড়িমোয়ার সাড়ে তিন হাজারটি প্যাকেট তৈরি করলেন। শোভাযাত্রা শেষে লোকজ ঐতিহ্যের আরেক মাত্রা যোগ হয়ে উৎসবকে মধুময় করেছিলো– সে অনুভূতি ভোলার নয়।
এ বছরেই নাগরিক ও সাংস্কৃতিক মিলন কেন্দ্র মহান ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠান "যশোর ইনস্টিটিউট"-এর বিরাট প্লাটফর্মে সকল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের মিলিয়ে উৎসব সমাজ গঠন করা হয় এবং আমরা জাতীয় উৎসব হিসেবে " বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা""র মেনুফেস্টো রচনা করে ফেলি।
চারুপীঠ ভবিষ্যৎ-রচনাকারী একটি কনসেপ্টভিত্তিক শিল্পের সামাজিকায়নের প্রতিষ্ঠান। শিল্পের সমাজ গঠনে চারুপীঠের সার্থক কর্মসূচি " বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা"কে একটি conceptual সামাজিক উৎসব হিসেবে রূপ দেয়া হয়েছিল।
১৯৮৭ সালে যশোরে তৃতীয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা থিম করা হয়েছিলো "জড়তামুক্ত, গুণী, রসিক, রঙিন, প্রাণখোলা, উৎসববাজ মানুষ চাই"। তাই এবছরের শোভাযাত্রায় প্রতিটা নারী পুরুষের ব্যক্তিগত সাজসজ্জা ও নৃত্য অঙ্গভঙ্গিমাকে গুরুত্ব দেয়া হলো। প্রাণ খুলে সাজতে, নাচতে, উপস্থাপনা করতে পারার সুবিধার কথা ভেবে শোভাযাত্রার জন্য রঙিন হালকা হাজার হাজার ঐতিহ্যের উপকরণ তৈরি করেছিলাম। শোভাযাত্রার ওপরটা রঙিয়ে দিতে কাপড়ের নানা রঙের ফেস্টুন করা হলো। ফেস্টুনে গার্হস্থ্য জীবনের মায়েদের শিল্প "যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে", "মধুর মিলন", "মা", "ভুলো না আমায়"-- এমন নানা সূচিশিল্পের বিষয় স্থান পেয়েছিল। নৃত্য, ঢাক-ঢোল সানাই এর সংখ্যা তিনগুণ বাড়িয়ে ষাট জন করা হয়েছিলো। গত বছরের সুবৃহৎ হাতি, কুমির, বৃহৎ আকৃতির বিষয়গুলো এ বছর আর নয়। "এক রথ প্রতি বছর টানার গতানুগতিক উৎসব এটি নয়, এই উৎসব প্রতি বছর নতুন ভাবনায় নতুন রূপে রচনা করতে হবে"-- একথা বলাই উদ্দেশ্য ছিলো আমাদের।
উৎসবে মেয়েদের পাশাপাশি পুরুষদেরও সাজ নেওয়া কি যে উপভোগ্য, কি যে আনন্দের তা সবাই-ই অনুভব করেছিল। পহেলা বৈশাখের প্রভাতে চারুপীঠের একাধিক পারফর্মিং দল সাজ নিচ্ছিল। ওদের জন্যে দশজন ঢাকি রেখে, বাকি পঞ্চাশ জন ঢাক ঢোল বাদকের দল নিয়ে বাদ্য বাজিয়ে আমি রাজপুত্রের সাজে বেরিয়ে পড়লাম যশোরের বড় বড় সাংস্কৃতিক সংগঠনের দিকে। তারা পারফর্মিং এর সজ্জায় সজ্জিত হয়ে প্রস্তুত ছিল। এক একটি প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে ঢাকের তালে তাদেরকে প্রাণভরে নাচিয়ে ভেন্যু অভিমুখে রওনা করিয়ে দিয়ে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছিলাম। নারী পুরুষ শিশু সবার নাচের আনন্দযজ্ঞের রেওয়াজ এভাবেই শুরু হলো।
মহান শিল্পী এস এম সুলতান তারুণ্যে এই শহরের অলিগলিতে পায়ে ঘুঙুর পরে শিশুদের আনন্দ দিতে হেঁটে বেড়িয়েছেন। অনুষ্ঠানে রঙে পা ভিজিয়ে নৃত্যের ছন্দে নেচে মঞ্চের মেঝেতে পদ্ম ফুল এঁকে যশোরবাসীকে অবাক করে দিতেন। এ বছর সুলতানের সাথে কথা বলেছিলাম তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে শোভাযাত্রায় আমাদের রাজার বেশে পায়ে ঘুঙুর পরে কত্থক নৃত্য শিল্পী সাজু আহমেদের নৃত্যদলের সাথে চলবেন। আর দড়াটানা মোড়ে রঙে পা ভিজিয়ে নেচে পদ্ম ফুল এঁকে দেবেন। মঙ্গল শোভাযাত্রা সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত এবং ভবিষ্যৎ ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে ফেললো।
পোল্যান্ড থেকে ফিলিস্তিনে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসে’ ইসরায়েল
এ সময়ে কিছু মানুষের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিরাট বাধা শাপে বর হয়ে দাঁড়ালো। যশোরে ১৯৮৮ সালে দেশের চতুর্থ বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" আগে কিছু রাজনৈতিক দলের জনসভায় কেন্দ্রীয় নেতারা বর্ষবরণ উৎসবকে বেধর্মী উৎসব ঘোষণা করা হয়। তাদের এই বাঙালির ভাষা, স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণ আমাদেরকে পরাজিত করতে পারে নাই। এবারও বাঙালি কৃষ্টিকে রুখতে তাদের এই কৌশল আমাদের জন্য শাপে বর হলো। বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" সাংস্কৃতিক বলয় ছাড়িয়ে রাজনীতিসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে এবং প্রতিটা পরিবারে পরিবারে আলোচনার বিষয় হয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে গেল। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরাট বাধা পেরিয়ে দ্বিগুণ কলেবরে বিজয়ী হলো বাঙালির কৃষ্টির বিজয় যাত্রা " বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা"।
১৯৮৯ সালে একযোগে যশোর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" প্রস্তুতি চলল।
যশোরে ৮৯-এর পঞ্চম বর্ষবরণ বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" কনসেপ্ট ছিল– বাংলা ভাষার প্রথম গদ্যসাহিত্যের চরিত্র বার ভুঁইয়াদের নেতা যশোররাজ রাজা প্রতাপাদিত্যের রাষ্ট্র এবং তাঁর বাণী– "আমরা আমাদের কৃষ্টি অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করব"।
শোভাযাত্রার নের্তৃত্বদান করলো রাজা প্রতাপের বিশজন টগবগে প্রাণোচ্ছল ঘোড়সওয়ার, এর পর জয়ঢাক ও সুন্দরবনরাজের প্রতীক বাঘের মুখোশের দল, বাঘের মুখ অলংকৃত উঁচু উঁচু রঙিন কাপড়ের রাজকীয় ফেস্টুনের সারির পরেই সত্যিকারের ঘোড়ায় টানা বাঙালি কৃষ্টির বিজয় রথ চলতে লাগলো। তার পর শোলার পাখা হাতে সাঁজোয়া নৃত্যদলের সাথে বাচ্চা কোলে বাঘ ম্যাডোনা। এর পর একের পর এক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ঢাক-ঢোল-সানাই-এর মূর্ছনায়, নৃত্যে-আনন্দে, ফুটিয়ে তুলেছিল বৈচিত্র্যময় যশোরাদ্য দেশের কৃষ্টি।
একই সাথে ভাষা স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চারুকলা ইনস্টিটিউটে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" সূচনা করা হলো। সবার মাথায় রাজসিক মুকুট। দশজন উচ্ছল রঙিন ঘোড়সওয়ার, শতাধিক মুখোশ, সোনার গাঁ-এর ঐতিহ্যের কাঠের পুতুলের হাতি এবং জুইস ভাই-এর পেপার ফোল্ডিং পদ্ধতিতে করা বাঘের মুখোশটি যেন এই শোভাযাত্রার সৌন্দর্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছিল।
পরবর্তী বছর, ১৯৯০তে, ময়মনসিংহ ও বরিশালের ছাত্রদেরকেও চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে গিয়ে, ওদের জন্মভুমি শহরে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" আয়োজন করতে উদ্বুদ্ধ করি। দেশে এক যোগে চারটি স্থানে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" অনুষ্ঠিত হলো। এভাবে অচিরেই সারা দেশে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" বাঙালির জাতীয় উৎসবে রূপ নিলো। আমরা ইতিমধ্যেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" মাধ্যমে দেশজ ঐতিহ্যের চর্চাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বের সাথে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" আয়োজন করছে।
বিশ্বের নানা দেশে পরবাসী বাঙালি ভাইবোনেরা বৈশাখী মেলা ও বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা" করছেন। আসছে বৈশাখে আমেরিকার বাঙালি সমাজ নিজ কৃষ্টিকে তুলে ধরতে সেখানে যে মহাউৎসবের পরিকল্পনা করেছে তাতে বাংলাদেশ পুলকিত।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এনডি