তেহরানে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে বাংলাদেশিরা, সরানোর পরিকল্পনা

ছবি: সংগৃহীত
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে টানা চারদিন ধরে চলমান সংঘাত ক্রমেই উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে। ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এখন পর্যন্ত ইরানে ২০০ জনের বেশি এবং ইসরায়েলে অন্তত ২৫ জন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
এই পরিস্থিতিতে তেহরানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস, প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকার।
তেহরান শহর ইসরায়েলি হামলার বড় একটি লক্ষ্যবস্তু হওয়ায় সেখানকার কূটনীতিক এবং প্রবাসীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, প্রথম অগ্রাধিকার হচ্ছে নিরাপত্তা। তেহরানে অবস্থান ঝুঁকিপূর্ণ হলে সেখান থেকে সরে যাওয়াই হবে যৌক্তিক পদক্ষেপ।
বর্তমানে তেহরানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, দুজন কূটনৈতিক কর্মকর্তা, পাঁচজন কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যসহ প্রায় ৪০ জন রয়েছেন।
এছাড়া রেডিও তেহরানে কর্মরত ৮ জন বাংলাদেশি এবং তাদের পরিবারসহ আরও ২৭ জন অবস্থান করছেন। শহরটিতে আরও ১০ থেকে ১২ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এবং ১০ জনের মতো পেশাজীবী রয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ১৩ জুন দেশে ফেরার কথা ছিল এমন ২৮ জন বাংলাদেশি বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় তেহরানে আটকা পড়েছেন। সব মিলিয়ে তেহরান শহরে বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা বর্তমানে শতাধিক বলে জানা গেছে।
ইরানের অন্যান্য অঞ্চলে প্রায় ৬০০ জন বাংলাদেশি রয়েছেন, যারা গত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে বসবাস করছেন। এদের অনেকেই স্থানীয়ভাবে বিবাহিত ও স্থায়ী বাসিন্দা।
এছাড়া প্রায় ৮০০ জন বাংলাদেশি ১০ বছরের বেশি সময় ধরে অবৈধভাবে ইরানে অবস্থান করছেন এবং বিভিন্ন খাতে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত। বর্তমানে ২০০ জনের মতো বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ইরানের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত।
প্রসঙ্গত, মানবপাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট দেশ হিসেবে ইরানে সবসময় ৩০০ থেকে ৫০০ বাংলাদেশি অস্থায়ীভাবে অবস্থান করেন—যারা পরে তৃতীয় কোনো দেশে পাচার হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন।
আরও পড়ুন: ইরানে বাংলাদেশিদের জন্য হটলাইন সেবা চালু
সাধারণত যুদ্ধ বা সংঘাতের সময়ে দূতাবাসে কর্মরত কূটনীতিকদের পরিবারকে প্রথমে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। তবে ১২ জুন রাতে ইসরায়েল হঠাৎ হামলা চালানোয় আগাম কোনো সতর্কতা না থাকায় পরিবারগুলোকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সরকারের একটি সূত্র জানায়, তেহরানে প্রায় শতাধিক বিদেশি দূতাবাস ও জাতিসংঘ সংস্থার অফিস রয়েছে এবং সেখানকার কর্মরত অধিকাংশ বিদেশি নাগরিকও তাদের পরিবার সরিয়ে নিতে পারেননি।
সূত্রটি আরও জানায়, ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা চলছিল, এমন সময়ে ইসরায়েল হামলা চালাবে—এটা কেউই ধারণা করেনি। ফলে দূতাবাসগুলোর কাছে আগাম কোনো সতর্কবার্তা পৌঁছায়নি।
রবিবার (১৫ জুন) ইরাক দূতাবাসের কাছাকাছি একটি এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। স্থানটি তেহরানের কূটনৈতিক এলাকার নিকটে অবস্থিত। এতে তেহরানজুড়ে আরও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিস্থিতি কার্যত যুদ্ধাবস্থায় পরিণত হয়।
বর্তমানে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারকে তেহরানের বাইরে নিরাপদ গ্রামীণ এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আকাশপথে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকানো স্বাগতিক দেশের পক্ষে কঠিন এবং কূটনীতিকদের নিরাপত্তা মূলত তাদের নিজস্ব উদ্যোগে নিশ্চিত করতে হবে।
তাদের মতে, ইরান থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে স্থলপথই এখন একমাত্র বিকল্প। ইরানের সীমান্ত রয়েছে পাকিস্তান, তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার সঙ্গে। তবে এসব দেশের সঙ্গে সীমান্ত পার হতে ভিসার প্রয়োজন হয়। এই মুহূর্তে সেই ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ পথ হলো পাকিস্তান সীমান্ত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার মতে, ইরানের বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করেই বাংলাদেশ দূতাবাসকে পদক্ষেপ নিতে হবে। মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার প্রস্তুতি রেখেছে। রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে এবং সম্ভাব্য নিরাপদ বিকল্প খোঁজা হচ্ছে।
এই মুহূর্তে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কেন্দ্রে তেহরান রয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। আকাশপথে চলাচল বন্ধ, সীমান্তে অনিশ্চয়তা এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হুমকি—সব মিলিয়ে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে বড় বিপদের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি