চিরঞ্জীব শেখ রাসেল
শেখ ইমতিয়াজ আকাশ

আজ ১৮ অক্টোবর। জাতির পিতার কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের ৫৭তম জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাড়ির উত্তর-পূর্বদিকের ঘরটি আলোকিত করে জন্ম নিয়েছিল জাতির পিতার কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেল।
শেখ রাসেলের যেদিন জন্ম হয়, বঙ্গবন্ধু সেদিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় চট্টগ্রামে ছিলেন। তখনকার দিনে মোবাইল ফোন না থাকায় ল্যান্ডফোনই ছিল দ্রুত যোগাযোগের একমাত্র ভরসা। রাতেই যেন বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর যায় সে ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।
সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা বলেন, “রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিলো ভীষণ উৎকণ্ঠার।! আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটেই না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমনবার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন, আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা।! কতক্ষণে দেখবো ভাইয়ের মুখ।
ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন সদ্য জন্ম নেয়া ভাই রাসেলকে। মাথাভরা ঘন-কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল। ”
জাতির পিতা শেখ মুজিব বৃটিশ দার্শনিক ও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন। রাসেলের বই পড়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। বঙ্গমাতা বার্ট্রান্ড রাসেলের ফিলোসফি শুনে শুনে এত ভক্ত হয়ে যান যে, নিজের ছোট সন্তানের নামই রেখে দিলেন রাসেল।
ছোটবেলা থেকেই রাসেল ছিল প্রচন্ড সাহসী। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু মতনই উদার চিত্তের পরিচয় যেন পাওয়া যাচ্ছিল তার চলনে-বলনে। তার আচার-আচরণ ছিল ব্যতিক্রম। শিশু রাসেলের সেই জ্বলজ্বলে সুতীক্ষ্ণ চোখ দুটোই যেন বলে দিচ্ছিল, এই শিশু অন্য দশটা শিশুর মতন নয়।
এদিকে, ঐতিহাসিক ৬ দফার পর থেকেই জাতির পিতা শেখ মুজিব কারাগারে বন্দি। শিশু রাসেল তখন একবারেই ছোট। মায়ের কোলে চড়ে জেলগেটে বাবার সাথে দেখা করে ছোট্ট শিশুটি।
ভাই রাসেলকে নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমার এখনো মনে আছে, যখন আমরা আব্বার সাথে দেখা করতে জেলগেটে যেতাম, আমরা আব্বাকে, ‘আব্বা’ বলে ডাকতাম। রাসেল তখন একবার আব্বাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতো, আরেকবার মাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতো। কারণ, তার অবুঝ মনের ব্যথা সে বলতে পারতো না। কিন্তু বুঝতে পারতো যে, সে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত।”
পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সাথে সাথে আক্রমন শুরু হলো, বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরের পরপরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। কিছুদিন পর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, দেশরত্ন শেখ হাসিনা, বঙ্গকন্যা শেখ রেহানা, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেলকেও গ্রেপ্তার করে ১৮ নম্বর রোডের একতলা একটি বাড়িতে নিয়ে রাখা হয়। শেখ কামাল তখন মুক্তিযুদ্ধে। ওই বাড়িতে দুটো কামড়ার মধ্যে বন্দি ছিলেন জাতির পিতার পরিবার। ছোট্ট রাসেল তখন কিছুই বুঝতো না। সেখানে ঠিকমত খাবার-দাবার ছিল না, ছিল না তার খেলার কোনো সাথি, কোনো খেলনাও ছিল না। কিন্তু এভাবেই বড়দের সাথে তাকেও বন্দি অবস্থায় থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন।
এরপর, দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করি। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পরিবার তখনো মুক্তি পায়নি। মুক্তি পান ১৭ ডিসেম্বর।
দেশ স্বাধীনের পর শেখ রাসেলকে রাজধানীর ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। তবে স্কুলে যেতে মাঝে মধ্যেই আপত্তি জানাত রাসেল। তখন স্কুলের গানের আপা ছিলেন জাহানার ইসলাম।
তার ভাষ্য মতে, খেলাধূলায় বেশি মনোযোগ ছিল শেখ রাসেলের। সেজন্য গানের দিকে তার বেশি আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আস্তে আস্তে শেখ রাসেল গানের প্রতিও আগ্রহী হয়ে ওঠে। যখন দেশাত্ববোধক যে গান হতো, সেগুলো চিৎকার করে গাইতো। তবে তখন যদি ছোট্ট রাসেলকে জিজ্ঞেস করা হতো, ‘বড় হয়ে তুমি কী হবে?’ তখন তার উত্তর ছিল, ‘আমি আর্মি অফিসার হবো’। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে সেই স্বপ্নের অকাল মৃত্যু হলো।
পৃথিবীর ইতিহাসে বহু রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ঘটেছে। কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেনি। ঘাতকরা জানতো, যদি জাতির পিতার পরিবারে একজন সদস্যও বেঁচে থাকে, তবে তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। তাইতো তাদের নিষ্ঠুরতা থেকে রেহায় পাইনি অন্তঃসত্ত্বা নারী থেকে ১১ বছরের শিশু রাসেলও। জাতির পিতার দুই কন্যা সেদিন যদি বিদেশে না থেকে দেশে থাকতেন তাহলে আজ বাংলাদেশের অবস্থা কেমন হতো তা কল্পনাও করা যায় না।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে আজ সাতান্ন বছরে পা রাখতেন। কিন্তু পঁচাত্তরের ঘাতকচক্র তা হতে দেয়নি। অথচ শিশু রাসেল সেদিন বাঁচতে চেয়েছিল। বাঁচার জন্য ঘাতকদের কাছে বার বার আকুতি জানিয়েছিল। যেতে চেয়েছিল পরম নিরাপদ আশ্রয় মায়ের কাছে। অথচ মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ঘাতকরা শিশু রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। শিশু রাসেল আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তার স্মৃতি আমাদের মাঝে থেকে যাবে চিরকাল।
নিউজবাংলাদেশ.কম/ডি