জুজুর ভয়ে যেখানে সবাই চুপ, সেখানে স্পষ্ট বাঁধন

ফাইল ছবি
বাংলাদেশের সমসাময়িক অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন শুধু পর্দার চরিত্রে নয়, বাস্তব জীবনেও হয়ে উঠেছেন সোচ্চার কণ্ঠস্বর। ধর্মীয় চরমপন্থা, সামাজিক রক্ষণশীলতা ও অদৃশ্য ভয়ের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাঁর সাম্প্রতিক অবস্থান তাকে আলাদা করে তুলেছে অন্যদের চেয়ে।
বুধবার (২৮ মে) নিজের ফেসবুক পেজে ‘জুজুর ভয়’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ পোস্টে বাঁধন শেয়ার করেছেন সেই ভয় ও তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ের কথা।
তাতে উঠে এসেছে— একজন নারী, একজন মা, একজন শিল্পী এবং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে কীভাবে তিনি একের পর এক সামাজিক বাধা পেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নিজের সত্য উচ্চারণে।
বাঁধন লিখেছেন, আমরা সবসময় এক ধরনের অদৃশ্য ভয়ের মধ্যে বেঁচে এসেছি… কোনো ব্যক্তির নয়, বরং একটি ব্যবস্থার ভয়। এই ভয় কোনো নির্দিষ্ট হুমকির নয়, বরং এক সংস্কৃতি, যেখানে প্রশ্ন করা মানেই ‘ধ্বংস হয়ে যাওয়া’। ‘হুজুররা শুনে ফেলবে’, ‘ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন কোরো না’—এই ধরনের সাবধানবাণী আমাদের বেড়ে ওঠার অংশ হয়ে উঠেছে।
বাঁধনের ভাষায়, এটি একধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কৌশল—‘জুজুর ভয়’।
২০১৮ সালে মেয়ের অভিভাবকত্বের সম্পূর্ণ অধিকার পাওয়ার পরও ভয় থেকে মুক্ত হতে পারেননি তিনি। সেই বিজয়ের পরও তাকে বলা হয়েছিল, “হুজুররা তোমার পেছনে লাগবে।” তিনি তখন সত্যি ভয় পেয়েছিলেন।
২০২১ সালে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবির পর এক কুইয়ার চরিত্রে অভিনয় করেন, যার গল্প একটি জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে।
তখন বলা হয়েছিল, “এবার তুমি শেষ।” সেই সময় বাঁধন পালানোর প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত দেশেই রয়ে যান।
আরও পড়ুন: ব্লু ফিল্ম র্যাকেটের অন্ধকারে ‘নীলচক্র’, এক সাহসী বাংলা থ্রিলার
২০২৪ সালে ‘জুলাই বিপ্লব’-এর সময় রাজপথে দাঁড়ানো, জিন্স-টি শার্টে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সময়েও তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে এই ‘জুজুর ভয়’।
২০২৫ সালে স্পষ্ট ভাষায় বলার সাহস রাখেন, “আমি জামায়াত বা কোনো চরমপন্থী দলকে ক্ষমতায় চাই না।” প্রতিবারই ভয়ের ছায়া তাকে ঘিরে ধরেছে, কিন্তু প্রতিবারই তিনি ‘বেঁচে গিয়েছেন’।
পোস্টের শেষাংশে বাঁধন বলেন, আমি হুজুরদের নেতৃত্ব গঠনের শৃঙ্খলাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমি একমত হতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকাকে ক্ষমা করতে পারি না।
তার বক্তব্য রাজনৈতিক নয়, মানবিক ও নৈতিক জায়গা থেকে উঠে আসা। মতপ্রকাশের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন— কোনো মতবাদের পক্ষ নেওয়ার মানে এই নয় যে আমরা অন্যের অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াব।
আজমেরী হক বাঁধনের এই পোস্ট কেবল ব্যক্তিগত সাহসের দলিল নয়, এটি এক সামাজিক আহ্বানও বটে—ভয়ের সংস্কৃতি ভেঙে বেরিয়ে আসার ডাক। তার লেখা তুলে ধরে যে, আমাদের এই ভয় মূলত কল্পনার দানব, যাকে সমাজ বারবার ব্যবহার করেছে নারী, তরুণ, প্রগতিশীল চিন্তার মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করতে।
তার এই অবস্থান দেশের বহু মানুষের মাঝে অনুপ্রেরণার জন্ম দিচ্ছে— বিশেষত তাদের, যারা নানা সামাজিক ভয়ের মুখে চুপ করে থাকতে বাধ্য হন। বাঁধনের কণ্ঠ এখন শুধু অভিনেত্রীর নয়, বরং এক প্রতীক—ভয়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহসিকতার প্রতীক।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি