ইতালিতে নাগরিকত্ব গণভোট বাতিল: ২৫ লাখ প্রবাসীর স্বপ্নভঙ্গ

ফাইল ছবি
দুই দিনব্যাপী এক বহুল আলোচিত গণভোটে ব্যর্থ হলো ইতালির নাগরিকত্ব আইন ও শ্রমিক সুরক্ষা বিষয়ক সংস্কার প্রচেষ্টা। মাত্র ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ ভোটার অংশ নেওয়ায় এই গণভোট আইনত বৈধতা পায়নি। ফলে প্রায় ২৫ লাখ বিদেশি নাগরিক, যাদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে ইতালিতে বসবাস করছেন, তাদের স্বপ্নভঙ্গ হলো আরও একবার।
এই ব্যর্থতার পেছনে শুধু ভোটার অনীহা নয়, স্পষ্টতই কাজ করেছে ডানপন্থি রাজনীতির শক্ত প্রতিরোধ, বিদেশি-বিরোধী প্রচার এবং ইতালির রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক ক্রমাগত ভাঙনের চিত্র।
এই গণভোটে পাঁচটি প্রস্তাব ছিল, যার মধ্যে তিনটি ছিল অভিবাসী ও শ্রমিক অধিকার সংশ্লিষ্ট:
- নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য ইতালিতে বসবাসের ন্যূনতম সময় ১০ বছর থেকে কমিয়ে ৫ বছরে নামানো।
- কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মালিক বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায় নির্ধারণ ও শাস্তি নিশ্চিতকরণ।
- শ্রমিকদের জন্য উন্নত কর্মসুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
বাকি দুটি প্রস্তাব ছিল প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং আঞ্চলিক সরকারগুলোর অধিকারের সম্প্রসারণ সংক্রান্ত।
এই প্রস্তাবগুলো আদালতের নির্দেশে গণভোটের জন্য উত্থাপিত হয়, যা আয়োজনে বড় ভূমিকা রাখে ইতালির বাম ও মধ্যপন্থি দলসমূহ, নাগরিক সমাজ এবং জাতীয় শ্রমিক ইউনিয়ন CGIL।
ইতালির আইন অনুযায়ী, কোনো গণভোটে ভোটার উপস্থিতি ৫০ শতাংশ না হলে তা বাতিল বলে গণ্য হয়। ইতিহাসে এমন ঘটনা নতুন নয়: ১৯৯৫ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ৩৪টি গণভোটের মধ্যে ৩০টিতেই ভোটার উপস্থিতি প্রয়োজনীয় সীমার নিচে ছিল।
তবে এইবার পরিস্থিতি আরও রাজনৈতিকভাবে তীক্ষ্ণ। কারণ, এই গণভোটে বিদেশি অভিবাসীদের জীবনধারার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল নাগরিকত্ব আইনের প্রস্তাব।
এই প্রস্তাবগুলো শুরু থেকেই বিরোধিতার মুখে পড়ে ডানপন্থি প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির সরকারের। “জাতীয় পরিচয় রক্ষা” ও “অবৈধ অভিবাসন রোধ”– এই প্রচারণা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছে তার দল Brothers of Italy, যার একটি প্রধান নীতি হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভ্যন্তরেও অভিবাসন সীমিত করা।
সরকারপন্থি মিডিয়া এবং ডানপন্থি দলগুলোর প্রচারাভিযান প্রচ্ছন্নভাবে গণভোটকে “বেহিসাবি উদারতা” হিসেবে তুলে ধরে জনমত প্রভাবিত করেছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের।
বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রচার বিদেশিদের বিরুদ্ধে ভীতি ও সন্দেহ উস্কে দিয়ে অনেক ইতালিয়ান নাগরিককে ভোটকেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করেছে।
ইতালিতে বসবাসকারী প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার বাংলাদেশির মধ্যে অধিকাংশই এই সংস্কারের পক্ষে ছিলেন। রোম, মিলান, নাপোলি, বলোনিয়া, ফ্লোরেন্সসহ প্রধান শহরগুলোতে থাকা বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে আশাভঙ্গ ও হতাশা ব্যাপক।
রোমে একটি বাংলাদেশি সংগঠনের সভাপতি জানান, নাগরিকত্ব পাওয়া আমাদের পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য খুব জরুরি ছিল। আমরা কর দিচ্ছি, কাজ করছি, আইন মানছি— কিন্তু এখনও আমরা ‘বিদেশি’। এই ব্যর্থতা আমাদের অবদানের স্বীকৃতি না পাওয়ারই আরেক রূপ।
সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপজুড়ে গণভোটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইতালির ক্ষেত্রে সমস্যা দ্বিমুখী। একদিকে রয়েছে ভোটারদের দীর্ঘস্থায়ী অনাগ্রহ বা হতাশা, যা রাজনৈতিক অবিশ্বাসের ফল। অন্যদিকে, গণভোট একটি সংস্কারমুখী হাতিয়ার হওয়ার পরিবর্তে হয়ে উঠছে রাজনৈতিক ব্লকের সংঘর্ষের মঞ্চ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডানপন্থার উত্থান, মিডিয়া ম্যানিপুলেশন এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ইতালির মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জনগণের মধ্যে ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। যার ফলে তারা ‘অপরিচিত’দের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রাণিত হচ্ছে।
জার্মানি এবং ফ্রান্স ইতোমধ্যেই নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত উদারনীতি গ্রহণ করেছে, যেখানে বসবাসকাল ৫-৮ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
সেই তুলনায় ইতালির ১০ বছরের শর্ত ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ। এই প্রস্তাব পাস হলে ইতালি এই বৈষম্য ঘোচাতে পারত, এবং অভিবাসীদের প্রতি আরও মানবিক ও বাস্তবতাসম্মত মনোভাব গ্রহণ করতে পারত।
প্রস্তাবগুলো আইন হয়ে বাস্তবায়িত না হলেও, এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে নাগরিক সমাজ, ইউনিয়ন, বামপন্থি রাজনৈতিক শক্তি এবং অভিবাসী সম্প্রদায় একত্রিত হয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে— অভিবাসন আর কেবল প্রান্তিক ইস্যু নয়, এটি আজ ইতালির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
যখন অভিবাসীরা দেশ গড়ার শ্রম দেয়, অথচ সেই রাষ্ট্র তাদের নিজের করে নিতে দ্বিধা করে— তখন সে রাষ্ট্রের গণতন্ত্র কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ব্যর্থতা সাময়িক হলেও এর অভিঘাত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
- রাজনৈতিকভাবে, ডানপন্থিদের আধিপত্য আরও সুসংহত হয়েছে।
- সামাজিকভাবে, অভিবাসীদের মধ্যে ভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার দীর্ঘ হতাশা আরও জোরদার হলো।
- সাংগঠনিকভাবে, বাম ও মধ্যপন্থি দলগুলো বুঝতে পারলো, সাংবিধানিক সংস্কারে জনগণের মনোভাবকে জাগিয়ে তোলা ছাড়া কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।
ইতালির এই গণভোট শুধু একটি আইন সংশোধনের প্রচেষ্টার পরিণতি নয়, বরং এটি একটি সামাজিক আয়না— যেখানে প্রতিফলিত হয় নাগরিকত্বের মূল্য, রাষ্ট্রীয় অন্তর্ভুক্তির দায়, এবং গণতন্ত্রের প্রাণ: ভোটার সক্রিয়তা।
এই ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হলো— নাগরিকত্ব কেবল কাগজের বিষয় নয়, এটি বিশ্বাস, নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় সমানাধিকারের প্রশ্ন।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি