১২ কর ছাড় একসঙ্গে বাতিল: বদলে যাচ্ছে করচিত্র

দেশের কর ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট প্রস্তুতির সময় ১২টি বিশেষ এসআরও (স্ট্যাচুটোরি রেগুলেটরি অর্ডার) বাতিল করেছে। 

২ জুন (সোমবার) জারি হওয়া এই সিদ্ধান্তটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিশ্চিত করেছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এসআরও বাতিলের ফলে বছরে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে।

সরকারি নীতিনির্ধারকদের মতে, এই পদক্ষেপের লক্ষ্য হলো কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা, কর ফাঁকি রোধ করা এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর প্রস্তাবিত আর্থিক শৃঙ্খলার কাঠামো অনুসরণ করা।

এসআরও বাতিলের ফলে কৃষি, মৎস্য, পোলট্রি, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা, সম্পত্তি হস্তান্তর, প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং নির্দিষ্ট জনহিতকর প্রতিষ্ঠানে দান ইত্যাদি খাতে কর ছাড় বা অব্যাহতির সুবিধা আর থাকছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পদক্ষেপটি স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে কিছু খাতকে চাপের মুখে ফেলতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের রাজস্বভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। তবে তারা পরামর্শ দিয়েছেন— ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষক ও খামারিদের জন্য বিকল্প প্রণোদনা বা ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখতে হবে।

আরও পড়ুন: বেঁধে দেওয়া দামেই বিক্রি হচ্ছে চামড়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা

বাতিল হওয়া ১২টি এসআরও-এর তালিকা ও বিশ্লেষণ

১. এসআরও-৩৩/২০০৯ (৯ মার্চ ২০০৯)

সুবিধা: বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, আরসিএইচ, এসএফডি হাসপাতাল-এ দান করমুক্ত

বাতিলের কারণ: রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও করের সমতা নষ্টের আশঙ্কা

২. এসআরও-৩৯৩/২০১৩ (২ জানুয়ারি ২০১৩)

সুবিধা: ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকস ফাউন্ডেশনে দান করমুক্ত

বাতিলের কারণ: জনহিতধর্মী দানের আড়ালে কর ফাঁকি

৩. এসআরও-১৯৯/২০১৫ (১ জুলাই ২০১৫)

সুবিধা: কৃষি, ফুল, রেশম, মাশরুম, হাঁস-মুরগি, মাছ ইত্যাদি খাতে করছাড় (৩%-১৫%)

বাতিলের কারণ: দীর্ঘমেয়াদে অকার্যকর; অপব্যবহারে রাজস্ব ক্ষতি

৪. এসআরও-২৫৫/২০১৫ (১৮ আগস্ট ২০১৫)

সুবিধা: পোলট্রি ও হ্যাচারির আয়ে শূন্য থেকে সীমিত কর

বাতিলের কারণ: কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সৃষ্টি

৫. এসআরও-১৩২/২০১৮ (১৩ মে ২০১৮)

সুবিধা: প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানিতে কর অব্যাহতি

বাতিলের কারণ: জ্বালানি খাতে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো

৬. এসআরও-২৭/২০১৯ (৩১ জানুয়ারি ২০১৯)

সুবিধা: গফুর মরিয়ম সাত্তার সাকেরা ফাউন্ডেশনে দান করমুক্ত

বাতিলের কারণ: জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের করছাড়ে স্পষ্ট নীতিমালার অভাব

৭. এসআরও-১৫৭/২০২২ (১ জুন ২০২২)

সুবিধা: হাঁস-মুরগি ও মাছ চাষে ধাপে ধাপে করছাড় (০-১৫%)

বাতিলের কারণ: পূর্ববর্তী সুবিধার পুনরাবৃত্তি; ফাঁকির ঝুঁকি

৮. এসআরও-২৫৩/২০২৩ (২৩ আগস্ট ২০২৩)

সুবিধা: সঞ্চয়পত্র ও সঞ্চয়ী আমানতে উৎসে করই চূড়ান্ত কর

বাতিলের কারণ: উচ্চ আয়ের ব্যক্তিদের কর ফাঁকি

৯. এসআরও-২৮৬/২০২৩ (১১ অক্টোবর ২০২৩)

সুবিধা: সম্পত্তি হস্তান্তরে উৎসে কর চূড়ান্ত; বাড়তি কর দানে ছাড়

বাতিলের কারণ: মূলধনি আয় কর ফাঁকি সহজ করা

১০. এসআরও-৩৮২/২০২৪ (৩ নভেম্বর ২০২৪)

সুবিধা: সিদ্ধ ও নন-সিদ্ধ চাল আমদানিতে কর অব্যাহতি

বাতিলের কারণ: স্থানীয় কৃষকদের প্রতিযোগিতা সংকট

১১. এসআরও-৩৮৩/২০২৪ (৪ নভেম্বর ২০২৪)

সুবিধা: বিশেষ করহার চালু যা অপ্রদর্শিত অর্থে বিনিয়োগ বৈধতা দিত

বাতিলের কারণ: দুর্নীতি ও বৈধতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা

১২. অপ্রকাশিত (সম্ভাব্য এসআরও-৩৪১ সংশোধনী)

সুবিধা: কর ফাঁকির সুযোগ সৃষ্টি করে এমন একটি পূর্ববর্তী নিয়ম সংশোধন

বাতিলের কারণ: অস্পষ্টতা ও আইনের ফাঁক ব্যবহারের ঝুঁকি

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়েছে, এসব পরিবর্তনের মাধ্যমে কর আদায়ের হার বৃদ্ধি পাবে এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কর আদায় ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হবে। ভবিষ্যতে কর ব্যবস্থায় আরও ডিজিটাল ট্র্যাকিং, ডেটা বিশ্লেষণ এবং স্বয়ংক্রিয় অডিটিং পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও রাজস্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংস্কার কার্যক্রম টেকসই রাজস্ব কাঠামো ও বাজেট ঘাটতি কমানোয় সহায়ক হবে। তবে সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখতে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোতে ক্ষতিপূরণমূলক নীতির প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন তারা।

এসআরও বাতিলের এই উদ্যোগ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা দীর্ঘদিন ধরে চলা কর ব্যবস্থার জটিলতা ও বৈষম্য দূর করার প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এতে স্বল্পমেয়াদে কিছু নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া থাকলেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি বাংলাদেশের স্বচ্ছ ও টেকসই অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।