নাহিদের বাংলা খাবারের খুশবাইতে মাতোয়ারা সুইডেন
ঢাকা: রসের গোলক এত রস কেন তুমি ধরেছিলে হায়/ইতালির দেশ, ধর্ম ভুলিয়া লুটাইলো তব পায়!
দু লাইনের এই পদ্যে ইতালির এক বন্দরে বাংলার রসগোল্লার স্বাদ আস্বাদনে আত্মবিমোহিত বিদেশিদের মুগ্ধতা ফুটিয়ে তুলেছিলেন কালজয়ী লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। ইউরোপের সমৃদ্ধ দেশ সুইডেনে বাংলা খাবারের রেস্টুরেন্ট ‘শান্তি’র কর্ণধার নাহিদের কীর্তিকলাপও অনেকটা সেই পর্যায়েরই বলা যায়। তার পাকানো আর পরিবেশিত খাঁটি বাংলাদেশি খাবার খেয়ে মাতোয়ারা সুডিডিশসহ অন্যরাও। শান্তির নিয়মিত খদ্দের সুডিশ রাজপরিবারের সদস্য, রাজনীতিক, ব্যবসায়ীসহ সবাই।
এখন ছুটি উপলক্ষে ঢাকায় নাহিদ। ধানমন্ডির এক রেস্টুরেন্টে বসে তার সঙ্গে আলাপে জানা গেল শান্তির সাফল্যগাঁথা।
নাহিদ হাসান একজন প্রকৃত উদ্যোক্তা। যিনি খাবার বিষয়টাকে ভালোবাসেন এবং যে কোনো উদ্যোগের অন্তরালে সনাতনী ব্যর্থতার পরিবর্তে দেখেন সম্ভাবনা।
ইউরোপে বিশেষ করে ব্রিটেনে প্রচলিত ভারতীয় খাবারের হোটেল বা ইন্ডিয়ান কারি হাউসগুলোর সিংহভাগের মালিক বাংলাদেশিরা। কিন্তু নানাবিধ বাস্তব-অবাস্তব কারণে বাংলাদেশ বা বাঙালির ঐতিহ্য সরাসরি স্বীকার করা হয় না এসব খাবার দোকানগুলোতে। প্রায় একই ধারা চলমান ইউরোপের অন্যান্য দেশের বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত রেস্টুরেন্টগুলোতেও।
অর্থনৈতিকভাবে অতি সমৃদ্ধ আর নোবেল পুরস্কারের দেশ সুইডেনেও একই অবস্থা চলমান ছিল। তবে সেই ধারায় আমূল পরিবর্তন এনেছেন ঢাকার ছেলে নাহিদ হাসান। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের ভারতীয় রেস্টুরেন্টগুলোর খাবার অকৃত্রিম না, মৌলিকও না- বারবার সেই খাবারের স্বাদ গ্রহণ করে এই ধারণা হয় তার। আর এরই সূত্র ধরে ২০০০ সালে তিনি স্টকহোমে চালু করেন তার নিজের প্রথম রেস্টুরেন্ট ‘শান্তি ক্লাসিক’। অনেক প্রতিকূলতা আর অধ্যবসায় শেষে বাংলা নামের সেই খাবার দোকান সফলতার মুখ দেখে ২০০৮ সালে। তখন তিনি তার দ্বিতীয় উদ্যোগ ‘শান্তি সফট কর্নার’ চালু করেন। তবে, নাহিদ এটাও স্বীকার করেন যে প্রথমদিকে এগুলোতেও ঠিক বাঙালি ঐতিহ্যের খাবার ছিল না।
নিউজবাংলাদেশকে নাহিদ বলেন, “স্টকহোমের ৯০ শতাংশেরও বেশি ভারতীয় রেস্টুরেন্টের মালিক বাঙালিরাই। কিন্তু দেখলাম, শহরটির মানুষ কখনোই প্রকৃত বাঙালি খাবারের স্বাদ পাইনি। আমি এর পরিবর্তন আনতে চাইলাম।”
নাহিদ যেহেতু এই ধারার আমূল পরিবর্তন করতে চাচ্ছিলেন, তাই নিজের প্রথম দুটি উদ্যোগ সফল হওয়ার পর ২০১৩ সালে তিনি বড় ধরনের ঝুঁকি নিলেন। তিনি বাঙালি আবহ আর ঐতিহ্যের আদলে ‘শান্তি’র কার্যক্রম শুরু করেন। এই শান্তি হবে সম্পূর্ণ বাঙালি রেস্টুরেন্ট। যেখানে খাবারগুলো সম্পূর্ণ বাঙালি ঘরোয়া রান্না পদ্ধতিতে তৈরি হবে এবং খাবারের তালিকাও সেভাবেই তৈরি হবে। পরিকল্পনা মতো সেখানে স্থান পায় বেগুন ভাজা, ডাল, মাছ-পোলাও এবং শর্ষে-ইলিশের মতো মনোমুগ্ধকর পদগুলো। যা সহজেই জয় করে সুইডিশদের মন আর রুচি।
একসময় জনপ্রিয় সুইডিশ সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিদের কাছেও গিয়ে পৌঁছায় শান্তির তৈরি বাঙালি রসুইর মশলাদার খুশবাই। সেই সুবাশের সুলুক সন্ধানে এসে তারা রসনা তৃপ্ত করেন, তোলেন তৃপ্তি ঢেকুর। হরেক পদের বাঙালি ব্যঞ্জনের মোহে তাদের অনুসরণে আসতে থাকেন শোবিজ তারকারাও। সেখানে আসতে শুরু করেন সুইডিশ রাজকুমার কার্ল ফিলিপ, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজেতা ভারতীয় কৈলাস সত্যার্থী, বলিউড পরিচালক সোনালি বোস, বাংলাদেশ এবং ভারতের রাষ্ট্রদূত, ভারতের মাস্টার শেফ বিজেতা সারনাশ গোইলাসহ আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি।
২০১৪ সালে নাহিদের রেস্টুরেন্ট জয় করে এশিয়ার-সেরা রান্নার পুরস্কারের খেতাব। ঠিক তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৩ তে সুইডিশ গুল্ডডারাকেন পুরস্কারেও ভূষিত হয় শান্তি রেস্টুরেন্ট।
চোখেমুখে হরদম আত্মবিশ্বাসীর ঝিলিক ছড়ানো নাহিদ নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “বাংলাদেশ গরিব দেশ হলেও, এ দেশের খাবারের সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। সেটাই আমি সগৌরবে তুলে ধরতে চাই ইউরোপ-আমেরিকায়। তাদের বুঝিয়ে দিতে চাই- বাংলাদেশের এই জেনারেশন অন্য ধাঁচের। যারা চায় সাফল্যের আকাশ ছুঁতে এবং সেখানে আবাস গাড়তে।”
নাহিদ নিজেকে একজন বাঙালি খাদ্যদূত বা প্রতিনিধি হিসেবেই দেখেন। তিনি অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ আর খাদ্যরসিক বাংলাদেশিদের সুন্দর দিকটি খাবারের মাধ্যমে তুলে ধরতে চান বিদেশিদের কাছে; যাদের চোখ-কান-মনন নানা কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক খবর আর ধারণায় অনেক সময় হয়েছিল এবং থাকে- ভারাক্রান্ত হয়ে।
আর এটা করতে গিয়ে তিনি এ দেশকে সবার কাছে সম্ভাবনাময় করে উপস্থাপন করেছেন। সুইডেনবাসী সুইডিশসহ অন্যান্য জাতির সদস্যদের কাছে তার প্রতিটি কথায়, আচরণে, সেবায় তিনি সেটাই তুলে ধরছেন বলে জানান সদ্য সুইডেন সফরকারী নিউজবাংলাদেশের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট (সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড) জামান সরকার। তিনি পাশের দেশ ফিনল্যান্ডের বাসিন্দা। সেখান থেকে প্রায়ই কাজের সূত্রে যান সুইডেন। আর স্টকহোমে গেলেই আস্বাদ নেন নাহিদের তৈরি খাবারের।
নাহিদ জানান, তিনি বাঙালি খাবার ভালোবাসেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারগুলো বাংলাদেশেই হারিয়ে যাচ্ছে।
২০১৪ সালে তিনি তার ৪র্থ রেস্টুরেন্ট ‘শান্তি গসিপ’ অর্থাৎ ‘শান্তি আড্ডাখানা’ চালু করেন। এই উদ্যোগটার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের পথঘাটের খাবার (স্ট্রিট ফুড) যেমন ফুচকা, খিচুড়ি, চটপটি, ভেড়ার (খাসির) মাংস ভুনা ইত্যাদিকে সুন্দরভাবে, আকর্ষণীয় করে ইউরোপীয়দের সামনে তুলে ধরা।
নাহিদের পঞ্চম রেস্টুরেন্টটি এ বছরের শেষ দিকে স্টকহোমেই চালু হতে যাচ্ছে। এর বৈশিষ্ট্য হবে হবে পুরান ঢাকার সেই সব ঐতিহ্যবাহী খাবার, যেই খাবার, যেই আবহের মৌতাতে এই ঐতিহ্যবাহী নগরীতে কেটেছে তার শৈশব, যেখানকার পথঘাট মাড়িয়ে বেড়ে উঠেছেন তিনি। তার স্বপ্ন মাতৃভূমি বাংলাদেশের মতো নিজ জন্মশহর ঢাকাকেও মর্যাদার সঙ্গে তুলে ধরবেন সুউডেনসহ পশ্চিমা বিশ্বে। সেই স্বপ্নকে সাকার করতে একের পর এক উদ্যোগ নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
নিজের বন্ধুভাগ্য খুব ভালো বলে জানালেন নাহিদ। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জানালেন, শুরুর দিকে অনেক রসকষহীন কর্কশ সময় পার করতে হয়েছে। তবে সেসময়টায় তার সুইডেনপ্রবাসী বাঙালি এবং সুইডিশ বন্ধুরা তাকে আগলে রেখেছেন, নিজেরা কাজ ফেলে এসে আড্ডা দিয়ে জমিয়ে তুলেছেন তার রেস্টুরেন্ট, নিজের বাসায় না খেয়ে তার এখানে খাবার কিনে খেয়েছেন যাতে তার উদ্যোগ শান্তি চলমান থাকে। ওই সময়টায় এবং এখনও তাকে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে গেছেন তার আপন ছোট ভাই নাঈম।
তরুণ বয়সে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশত্যাগী স্বপ্নবাজ এবং একই সঙ্গে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নাহিদ জানান, খাবারের সঙ্গে সঙ্গে রেস্টুরেন্টের পরিবেশ এবং আসবাব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যাতে আমাদের এখানে খেতে এসে মানুষ সেই বাঙালিয়ানা পরিবেশটা অনুভব করে।
এটা অবশ্য নাহিদের চিন্তায় আগে থেকেই ছিল। কারণ, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পড়াশোনার বিষয় ছিল ফ্যাশন ডিজাইনিং। তো এই জ্ঞান-অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত শিল্পসুষমা পুরোটারই প্রয়োগ করেছেন তিনি শান্তির ডেকোরেশনে।
আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মিলনের ফলে তার রেস্টুরেন্টগুলোয় একটা চিরকেলে আরামদায়ক প্রশান্তির পরিবেশ তৈরি করে যা মানুষমাত্রেই কামনা করে। আর তাই রেস্টুরেন্ট ‘শান্তি’ প্রকৃতপক্ষে সবার মনেই ভালো লাগে, এনে দেয় শান্তির আবেশ। নতুন নতুন রেস্টুরেন্ট খোলার পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার নিজের রান্না বিষয়ক বই প্রকাশ, মসলা উৎপাদন, রান্নার ক্লাস, টেলিভিশনে রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠান এবং বাংলাদেশে চলমান বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েও কাজ করছেন সমান তালে। সুইডিশ টেলিভিশনে হামেশাই দেখা যায় তাকে রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠানে।
এখন সপরিবারে সুইডেনের বাসিন্দা নাহিদের জন্ম মুন্সিগঞ্জের ষোলঘরে। তবে বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকার হৃষিকেশ দাশ রোডে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/একে/এজে
নিউজবাংলাদেশ.কম








