‘খামখেয়ালির’ চক্করে ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ
ঢাকা: ভোটার তালিকা হালনাগাদের প্রথম ধাপে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন থেকে নির্বাচন কমিশনকে তাই পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে অনেকখানি।
হালনাগাদ কার্যক্রম নিয়ে ইসির পরিকল্পনায় ‘গলদ’ আর তথ্য সংগ্রহকারীদের ‘খামখেয়ালির’ অভিযোগও পাওয়া গেছে। হালনাগাদের জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ থাকলেও প্রশ্ন উঠেছে প্রচারণায় ঘাটতি নিয়ে। শনিবার (৯ আগস্ট) হালনাগাদ কার্যক্রম শেষ হচ্ছে একরকম ‘অসফল’ ভাবেই। সংশ্লিষ্টরা এমন মন্তব্যই করেছেন।
গত ২৫ জুলাই ভোটার তালিকা হালনাগাদের প্রথম পর্ব শুরু হয়। এ ধাপে ১৮৯টি উপজেলায় তথ্য সংগ্রহ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে বৈরী ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকায় অনেক উপজেলাতে তথ্য সংগ্রহকারীদের পড়তে হচ্ছে মারাত্মক বিপাকে। কয়েকদিনের ক্রমাগত ভারী বর্ষণে দেশের অনেকস্থানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন যে পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করার কথা ছিলো, তার অর্ধেকও করা যায়নি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এজন্য ইসিকেই দুষছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ইসির ‘গলদ’ পরিকল্পনার কারণে তথ্য সংগ্রহকারীদের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। দেশের প্রাকৃতিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা না করেই হালনাগাদের সময় নির্ধারণ করেছে ইসি। এজন্য ইসিকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, অনেক জায়গাতে তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেনি। তারা তাদের ‘খামখেয়াল’ মতোই তথ্য সংগ্রহ করছেন। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে সঠিক সময়ে ভোটার তালিকাভুক্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
তবে এমন অভিযোগের জবাবে ইসি বলছে অন্য কথা। জেলা ও উপজেলা থেকে ইসিতে পাঠানো প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ইসির দাবি- টানা বৃষ্টি আর বন্যার কারণে প্রথম পর্যায়ের অধিকাংশ এলাকায় বাড়ি বাড়ি যেতে পারেনি তথ্য সংগ্রহকারীরা। তাই সীমিত আকারে তথ্য সংগ্রহের কাজ করতে হয়েছে।
এদিকে, ভোটার তালিকা হালনাগাদ নিয়ে সঠিকভাবে প্রচারণা চালানো হয়নি বলেও স্থানীয় তথ্য সংগ্রহকারীরা জানান। নোয়াখালীর এক তথ্য সংগ্রহকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “আমরা তো মানুষের বাড়ি বাড়ি যাই। কিন্তু হালনাগাদ নিয়ে মানুষ ভালো করে কিছুই জানে না। তথ্য সংগ্রহে এজন্য আমাদেরকে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হয়েছে।”
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রাকৃতিক দুযোর্গের কারণে প্রথম ধাপে শুরু হওয়া হালনাগাদ কার্যক্রমে সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হয়নি। নারী ভোটারদের অন্তভূক্তিও তাই কম পাওয়া গেছে। দুর্যোগ ও বন্যা কবলিত এলাকায় সময় বৃদ্ধিরও দাবি জানান তারা।
এ বিষয়ে কুমিল্লার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা বিভোর কুমার বিশ্বাস নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “টানা বর্ষণে নোয়াখালী-ফেনীর অনেক এলাকা প্লাবিত। বাসিন্দারের অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে অন্যস্থানে অবস্থান করছেন। অনেকস্থানে পুরুষদের পাওয়া গেলেও নারীদের দেখা মেলেনি।”
তিনি আরও বলেন, “পানি মাড়িয়ে তথ্য সংগ্রহকারীদের বাড়ি বাড়ি যেতে অনেক কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। কষ্ট করে অনেক বাড়ি গিয়েও তাদের ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসতে হয়েছে। ফলে বাড়ি বাড়ি যাওয়ার আগ্রহে ভাটা পড়াটাও স্বাভাবিক। তবে এসব এলাকায় আরও কয়েকদিন সময় বাড়ালে আরও বেশি তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।”
বন্যার কারণে ফেনীর হালনাগাদ কার্যক্রম ‘এলোমেলো’ হয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হোসেন। নিউজবাংলাদেশকে তিনি বলেন, “মানুষ তাদের জীবন ও ঘরবাড়ি বাঁচাতে ব্যস্ত। তথ্য সংগ্রহকারীরাও বাড়ি বাড়ি যেতে পারছে না। তথ্য সংগ্রহ কিছুটা তো কম হবেই। তবে সময় বাড়ালে এ ঘাটনি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।”
এদিকে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আবদুল বাতেন দাবি করেন, “বন্যা ও ভারী বর্ষণে তথ্য সংগ্রহ খানিকটা বাধাপ্রাপ্ত হলেও এখন আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে।”
হালনাগাদ নিয়ে ইসির পরিকল্পনাকেও দুষছেন কেউ কেউ। তাদের মতে, এ সময়ে হালনাগাদ কাযক্রম শুরু করা কোনওভাবে ঠিক হয়নি। মাঠপর্যায়ে প্রস্তুতিও কম ছিলো। ঈদের পরপরই তথ্য সংগ্রহের পরিকল্পনাকে ‘বোকামি’ বলছেন তারা। ঈদের আমেজে তথ্য সংগ্রহের কাজে ভাটা পড়েছে বলেও দাবি তাদের।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এক নির্বাচনী কর্মকর্তা বলেন, পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি ছাড়া হালনাগাদ কাযক্রম শুরু হয়েছে। ভরা বর্ষায় কাজ শুরু না করে কিছুদিন বিলম্বে শুরু হলে ভাল হত। কিন্তু ইসি তা করে নি। এখন তথ্যসংগ্রহকারীদের বেশ দুর্ভোগে পোহাতে হচ্ছে। পরবর্তী ধাপে আবারও একই সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে।”
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব.) সাখাওয়াত হোসেন নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “পরিকল্পনাই তো প্রধান বিষয়। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে অনেক কিছুই মুখ থুবড়ে পড়ে। বর্তমানে ইসির ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। অনেক টাকা খরচ হচ্ছে ঠিকই, সঠিক ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এটা সত্যিই দুঃখজনক। একটু সুন্দর পরিকল্পনা করলে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হতো না।”
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে ইসির উপসচিব আবদুল অদুদ নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “মাত্র তো একটি ধাপ শেষ হতে যাচ্ছে। জেলা পর্যায় থেকে এখনও রিপোর্ট আসেনি। সব জানার পরে প্রয়োজন হলেও সময় বাড়ানো যেতে পারে। বিষয়টি ইসি বিবেচনা করবে।”
“তাছাড়া সারাবছরই তো ভোটার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে ভোটার হতে পারলে উপজেলা নিবন্ধন কার্যালয় কিংবা নিবন্ধন কেন্দ্রে তথ্য দিয়ে দিয়ে ভোটার হওয়ার সুযোগ সারাবছরই আছে” বলেন এ কর্মকর্তা।
এদিকে, খানিকটা দেরিতে হলেও ইসির পক্ষ থেকে প্রচারণা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ইছি।
প্রসঙ্গত, গত ২৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া হালনাগাদ কার্যক্রম সারাদেশে তিনধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম ধাপ ৯ আগস্ট (শনিবার) শেষ হচ্ছে। এবারেই প্রথম হালনাগাদে ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়েসীদের (যাদের জন্ম ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি বা তার আগে) অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপে আগামী ১৬ আগস্ট থেকে ৩০ আগস্ট পযন্ত ১৮৪ উপজেলায় এবং শেষ ধাপে ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪১ উপজেলায় এ কার্যক্রম চলবে।
এবার হালনাগাদে সাড়ে ৭ শতাংশ নতুন নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ইসি। সে অনুযায়ী প্রায় ৭২ লাখ নতুন নাগরিক তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছে।
২০১৪ সালের সবশেষ হালনাগাদের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে বর্তমানে ৯ কোটি ৬২ লাখের বেশি ভোটার রয়েছে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/একে
নিউজবাংলাদেশ.কম








