News Bangladesh

|| নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২০:০৪, ২৭ আগস্ট ২০১৫
আপডেট: ১৫:৩৯, ১৪ এপ্রিল ২০২০

স্ত্রীর সম্ভ্রম হারানোর ‘লজ্জায়’ স্বামীর আত্মহত্যা!

স্ত্রীর সম্ভ্রম হারানোর ‘লজ্জায়’ স্বামীর আত্মহত্যা!

সুনামগঞ্জ: স্ত্রীর সম্ভ্রম হারানোর ঘটনায় ‘লোক লজ্জায়’ আত্মহত্যা করেছেন স্বামী। বুধবার সন্ধ্যায় চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর পাড়ের গ্রাম দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের পৈণ্ডুপে। আত্মহননকারীর নাম কমল সরকার (২২)। তিনি গ্রামের মৃত ননী গোপাল সরকারের ছেলে।

এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার দুপুরে তাহিরপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন ও আত্মহত্যার প্ররোচনায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলা দুটি করেছেন কমল সরকারের শ্বশুর। পুলিশ দুই ধর্ষক অমল সরকার (৩৫), রাজিব তালুকদার (২৪) এবং সালিশের সঙ্গে যুক্ত পৈণ্ডুপ গ্রামের কৃপাসিন্দু তালুকদার (৭০), কামিনী তালুকদারের ছেলে কাজল তালুকদার (৩৫), মাখন সরকারের ছেলে জয়ন্ত সরকার (৩২) এবং জামালগঞ্জ উপজেলা বেহেলী ইউনিয়নের হরিনাকান্দি গ্রামের রফিকুল ইসলাম (৪৮) ও ফখর উদ্দিন (৬০) সহ ৭ জনকে আটক করেছে।

বৃহস্পতিবার বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ ও তাহিরপুর থানা ওসি শহিদল্লাহ। পুলিশ সুপার পৈণ্ডুপ গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলেন এবং ঘটনায় জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার আশ্বাস দেন।

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত সোমবার রাতে হাওরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন পৈণ্ডুপ গ্রামের দরিদ্র কৃষক কমল সরকার। ওই রাতে তার মা বাড়িতে ছিলেন না, স্ত্রী বসতঘরে একাই ঘুমিয়ে ছিলেন। এই সুযোগে একই গ্রামের পটু সরকারের ছেলে বখাটে অমল সরকার (৩৫) ও রোপেশ তালুকদারের ছেলে রাজিব তালুকদার (২৪) কমল সরকারের ঘরে ঢুকে তার স্ত্রীর হাত ও মুখ বেঁধে ধর্ষণ করে। কমল সরকার হাওর থেকে ভোরে বাড়ি ফিরে তার স্ত্রীকে হাত ও মুখ বাঁধা অবস্থায় পান। বিষয়টি জানাজানি হলে ঘটনার একদিন পর বুধবার এ নিয়ে  গ্রামে সালিশ অনুষ্ঠিত হয়।

সালিশে অভিযুক্ত দুই বখাটে অমল ও রাজিব নিজেদের দোষ স্বীকার করলে তাদের গলায় টিন বেঁধে সারা গ্রাম ঘুরানো হয়। কিন্তু গ্রাম্য সালিশের এই রায়ে সন্তুষ্ট হননি নির্যাতিতার স্বামী কমল সরকার।

এদিকে, সালিশ বিচারের পর পরই কমলের স্ত্রীকে বাবার বাড়ির লোকজন নিয়ে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় নিজ বসত ঘরে আত্মহত্যা করে কমল সরকার। প্রতিবেশী ধীরাজ সরকার তার লাশ ঝুলতে দেখে গ্রামবাসীকে জানান। পরে গ্রামবাসী পুলিশে খবর দেয়।

কমলের আত্মহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায় অমল সরকার। এসময় গ্রামের লোকজন রাজিব তালুকদারকে আটক করে রাখলেও পরে কিছু প্রভাবশালী লোকের সহায়তায় পালিয়ে যায় সেও।

খবর পেয়ে পুলিশ বুধবার রাত ১১টায় কমল সরকারের লাশ উদ্ধার করে। এসময় পুলিশ পৈণ্ডুপ গ্রাম থেকে সালিশে জড়িত কৃপাসিন্দু তালুকদার, কাজল তালুকদার, জয়ন্ত সরকার, জামালগঞ্জ উপজেলা বেহেলী ইউনিয়নের হরিণাকান্দি গ্রামের রফিক মিয়া ও ফফির মাহমুদকে আটক করে। পরে পুলিশের হাতে আটক ওই ৫ জনের স্বজনরা গত বৃহস্পতিবার ভোরে পালিয়ে যাওয়ার পথে জামালগঞ্জের হালীর হাওর থেকে ধর্ষক রাজিব তালুকদার ও ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর থানার নগদাপাড়া গ্রাম থেকে অমল সরকারকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।

দুর্গম হাওর পাড়ের গ্রামের এই ঘটনাটি বৃহস্পতিবার জানাজানি হলে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়। সমগ্র হাওরবাসী দুই ধর্ষকের কাঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছে। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, ঘটনার পরদিন ভিকটিমকে থানায় যাওয়ার পরামর্শ না দিয়ে আলামত নষ্ট করা ও ধর্ষকদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে সহায়তা করার। এছাড়া সালিশের পর বুধবার বিকালে আবারো কমল সরকারের পরিবারের সাথে আপোষ সমঝোতা করার চেষ্টা করে সমাজপতিরা। কিন্তু এলাকার কয়েকজন সচেতন লোক বিষয়টি গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়ে দিলে ও পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ায় গ্রাম্য মোড়লদের সব অপচেষ্টা ভেস্তে যায়।

এদিকে বখাটেদের হাতে প্রথমে নিজের মান-সম্মান ও পরে স্বামী হারিয়ে নিঃস্ব ওই গৃহবধূ নির্বাক হয়ে পড়েছেন। ঘটনার পর থেকে তিনি কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন এবং অনশনে দিন কাটাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে উপস্থিত ওই গৃহবধূ দুই বখাটেসহ শালিস বিচারের সাথে জড়িত সবার কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন। দুপুরে সদর হাসপাতালে কমল সরকারের লাশের ময়না তদন্ত ও তার নির্যাতিত স্ত্রীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে।

আটকদের বিরুদ্ধে নির্যাতিতা গৃহবধূর বাবা বাদী হয়ে থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেছেন। ধর্ষক অমল সরকার ও রাজিব তালুকদারের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি এবং অমল সরকার, রাজিব তালুকদার, সালিশকারী সজীব তালুকদার, কাজল তালুকদার, জয়ন্ত সরকার, ফকর উদ্দিন, রফিকুল ইসলাম, কৃপাসিন্দু তালুকদার, বিমল তালুকদার, দেবেশ তালুকদার, রতি তালুকদার, চিত্ত রঞ্জন তালুকদার, সামন্ত তালুকদার, সিতু তালুকদার, প্রবোধ তালুকদার, নম্টু তালুকদার, অনিল সরকারসহ অজ্ঞাতনামা আরো ৫-৭ জনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে আরেকটি মামলা করা হয়েছে।

পৈণ্ডুব গ্রামের বাসিন্দা পল্লী চিকিৎসক পিযুষ তালুকদার বলেন, “আমি তাহিরপুরে থাকি, বুধবার সন্ধ্যার পর বাড়িতে গিয়ে শুনেছি এ ধরনের একটা বিচার হয়েছিল। বিচারে অমল সরকার ও রাজিব তালুকদার দুইজনই নাকি নিজেদের দোষ স্বীকার করেছে। পরে কমল সরকার আত্মহত্যা করেছে।”

তাহিরপুর থানা ওসি শহিদুল্লাহ বলেন, “পৈণ্ডুপ গ্রামের আত্মহননকারী যুবকের লাশ উদ্ধারের পর সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত ও নির্যাতিত গৃহবধূর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। আটক দুই ধর্ষকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এবং সালিশের সাথে জড়িত আটক ৫ জনসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হয়েছে। শালিসের সাথে জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করার অভিযান চলছে।”

পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ বলেন, “পৈণ্ডুপ গ্রামের গৃহবধূ গণধর্ষণ ও তার স্বামীর আত্মহত্যার ঘটনাটি বিশেষ নজরে দেখা হচ্ছে। দুই ধর্ষকসহ ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া ওই ঘটনা দুটির সাথে যারা জড়িত তাদের সবাইকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।”

নিউজবাংলাদেশ.কম/একে
 













নিউজবাংলাদেশ.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়