পিনাক ৬ ট্রাজেডির ১ বছর: সাজা পায়নি দোষীরা
মাদারীপুর: ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট পদ্মা নদীর মাঝে আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় পিনাক ৬ নামের লঞ্চটি। পিনাক ৬ যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। নাম শুনলেই আতঙ্কে কেঁপে ওঠে স্বজন হারাদের বুক। সেদিন মুহুর্তের মধ্যেই আনন্দের ঈদ বিষাদে পরিণত হয়। পিনাক ৬ দুর্ঘটনার ১ বছর পেরিয়ে গেলেও দোষীরা আজো সাজা পায়নি। ভুক্তভোগীদের ধারণা, দোষীরা আর সাজা পাবে কি না সন্দেহ। শুধু চোখের পানিতে বুক ভাসাবে স্বজন হারা মানুষেরা!
ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাওড়াকান্দিঘাট থেকে মাওয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায় পিনাক ৬ লঞ্চটি। ওভারলোডিংয়ের কারণে পদ্মার মাঝে ডুবে যায় লঞ্চটি। সরকারিভাবে ওই দুর্ঘটনায় ৪৯ এবং বেসরকারি হিসেবে ৮৬ যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। জীবিত কিছু মানুষ উদ্ধার হন বিভিন্ন উপায়ে। নিখোঁজ ছিলেন ৫৩ জন। যাদের হদিস আজো মেলেনি। এ সময় পদ্মার তীরে স্বজনহারাদের আহাজারি আর বুকফাঁটা আর্তনাদে ম্লান করে দেয় ঈদের আনন্দ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ দুর্ঘটনায় বহু মূল্যবান ও সম্ভাবনাময় জীবনের সলিল সমাধি হয়েছে। তাতে লঞ্চ মালিকদের কিছু যায় আসে না। ওভারলোডিং থামেনি বরং লঞ্চ মালিক-শ্রমিকদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে কয়েকগুণ। আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত রিপোর্ট। ছাড়া পেয়ে গেছে লঞ্চ মালিক। বিচারের প্রত্যাশা যেন অর্থহীন।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সে বছর পিনাক ট্রাজেটির পর উভয় ঘাট থেকে প্রতিটি লঞ্চ ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক যাত্রী নিয়ে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছিল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে। এ কাজের সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে তদারকি অব্যাহত রেখেছিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্থানীয় প্রশাসন, বিআইডব্লিউটিএ ও পুলিশ প্রশাসন। হঠাৎ নৌ-রুটগুলোতে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। কমাস লঞ্চগুলোতে অতিরিক্ত যাত্রী দেখা যায়নি। কিন্তু কমাস যেতে না যেতেই লঞ্চ মালিক-শ্রমিকরা আবার ফিরে যায় তাদের পুরনো স্বভাবে। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে উত্তাল পদ্মা পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়ে যায়। এখন আর পদ্মা উত্তাল থাকলেও যাত্রী পারাপারে নেই কর্তৃপক্ষের তদারকি। নেই প্রশাসন ও পুলিশি তদারকিতে লঞ্চে গুনে-গুনে যাত্রী তুলে দেওয়ার সেই আগের চিত্রও। মন্ত্রীর কড়া হুঁশিয়ারিও কোনো কাজে আসছে না। এ সিন্ডিকেট এতোই শক্তিশালী যে, তাদের কাছে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে আছে অনন্তকাল ধরে। তাই মানুষের জীবন তাদের কাছে তুচ্ছ। তাদের চাই অর্থ উপার্জন।
মাদারীপুর জেলার শিবচরে স্বজন হারানো কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিরব-নিস্তব্ধ বাড়ির চারপাশ জুড়ে যেন বিষাদের ছায়া। ঈদ করতে গ্রামে এসেই স্বজনদের হারানো পরিবারের মাঝে ঈদ আর আনন্দ বয়ে আনবে না। তাদের কাছে এখন ঈদ মানেই শুধু স্বজন হারানোর কষ্ট।
শিবচর উপজেলার পাঁচ্চর ইউনিয়নের লপ্তেরচরে পিনাক ৬ লঞ্চ ডুবিতে নিহত মিজানুর হাওলাদারের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে বিষাদের ছায়া। বেঁচে থাকা বৃদ্ধ মায়ের ঘোলাটে চোখে শুধু লোনা পানি। ঈদ এলেই বৃদ্ধ মায়ের বুক ব্যথায় ভারি হয়ে ওঠে।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া নিহত মিজানের মা রিজিয়া বেগমের সঙ্গে কথা বলতে গেলে বারবার চোখ মোছেন তিনি। যা বলতে চান কান্না এসে আটকে যায় তার কণ্ঠ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “যে কদিন বেঁচে থাকবো ঈদের আনন্দ আর আসবে না। গত বছরের ঠিক এই সময় পুত্র-পরিজনদের সাথে ঈদ কেটেছে। ছিল এক অন্য রকম ভালো লাগার অনুভূতি। ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনিদের নিয়ে সময় কেটেছে আনন্দে। সন্তান হারানো শোকে মিজানের বাবা নুরুল ইসলামও সবাইকে ছেড়ে চলে গেল।”
নিহত ফরহাদের ১২ বছর বয়সী বোন প্রিয়া আক্তার বলেন, “গত বছর ভাই-ভাবিসহ ৪জন লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা যান। আমরা তাদের লাশও পাইনি।”
শিবচরে নিহত এমন আরও বহু পরিবারে রয়েছে স্বজন হারানোর বেদনা।
নিউজবাংলাদেশ.কম/কেজেএইচ
নিউজবাংলাদেশ.কম








