মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায় অরজিতের।
সে স্বপ্ন দেখছিল, বিশাল দেহাকৃতি এক মানব শম্ভুর। যার অবয়ব জুড়ে ছোট ছোট মানুষের অবাধ চলাফেরা। কেউ বুক পকেটে, কেউ কাধে, কেউ নাকের ডগায়, কেউবা আবার কোমরে-পাজরে। তার সমস্ত শরীর জুড়ে ছোট ছোট মানুষ বসবাস করছে।
অরজিত স্বপ্নের স্মৃতিচারণ করতে চেষ্টা করে। কিছু স্পষ্ট আবার কিছু অস্পষ্টতা তাকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। এমন স্বপ্ন মানুষ দেখে! দেখে তো, না দেখলে অরজিত এমন স্বপ্ন দেখলো কেনো?
দৈত্যাকৃতি শম্ভুর শরীরে, বসবাসরত পিচ্চি-পিচ্চি মানুষের চোখের দৃষ্টি; এদিক সেদিক ঘুরছে। টহল দিচ্ছে, তাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে। মাঝে মধ্যে কানের কাছে গিয়ে ফিস ফিস করে কী যেন বলছে, তা অরজিত বুঝতে পারে না। তবে, আন্দাজ করে, পিচ্চি মানুষের কান কথায়; শম্ভুর মুভমেন্ট।
অরজিত আবার ঘুমিয়ে যায়।
স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
পাহাড়ের চূড়ায় ও বসে আছে। সামনের উচু পাহাড় চূয়ে ঝরনা ঝড়ছে। চমৎকার দৃশ্য। পাথরের বুকে ঝরনার আছড়ে পড়ার শব্দে মুহূর্তে মুহুর্তে অরজিত পুলকিত হয়। নয়নাভিরাম সে দৃশ্যের মূর্ছনায় নিজেকে বিমোহিত করে তোলে।
জোসনার আলো এসে পড়ে অরজিতের গায়। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। অপলক চেয়ে আছে ঝরনার দিকে। এক সময় মনে হয় কেউ একজন পাথরে বসে স্নান করছে। বিচলিত হয়ে আবিস্কার করে। সত্যিই তো; এক মানবী। অপরুপ সৌন্দর্যের রঙ মেখে সে জোসনা জলে স্নান করছে। অরজিত চুপিসারে একটু এগিয়ে যায়। ঝোপের আড়াল থেকে অবলোকন করে।
এমন সুন্দর দৃশ্য অরজিতের পৃথিবীতে একটিও নেই। কখনও সে কল্পনাও করতে পারেনি; মানুষ এতো সুন্দর হয়। জোসনার আলো এখানে মৃত, বিলীন। ঝরনার জলে যে সরবর স্রোতস্বিনী জলের ধারা তৈরি হয়েছে সে সরবর জল-মানবীর রূপে আলোকিত। জলের কলকলানিতে রূপালি ঢেউ। লতা-গুল্মে জলের ফোটা পড়ে চিকিচিক করছে; মন ভরে দৃশ্যগুলো অরজিত দেখে যায়। শান্তির শীতল বাতাস তার গায়ে লাগে, ভাল লাগতে থাকে।
নির্ভয়ে অবয়বের ভাজ খুলে রূপসী স্নান করছে। ভিখুর চোখ মেলে অরজিত ঝোপের আড়াল থেকে স্নান করা দেখে যায়। নয়নাভিরাম দৃশ্য দুচোখের দৃষ্টি মেলে উপভোগ করার মতো আনন্দ, সুখ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। ধিরে ধিরে অরজিত জোসনা স্নানে এগিয়ে গিয়ে থেমে যায়। এতোক্ষণ যেটাকে পাথর ভেবে নিয়েছিল সেটা আসলে পাথর না; সেই বিশাল দেহাকৃতি, দৈত্যরূপি শম্ভু।
আতংকে বিছানায় বসে পড়ে অরজিত।
কী দেখলাম! এমন স্বপ্ন দেখলাম কেন? আবারও প্রশ্নের ঝড় তাকে খুব ভাবিয়ে তোলে। এ রাতে আর ঘুমানো যায় না। এমন অদ্ভূত স্বপ্ন দেখে কেন? আবার সেই ভয়ঙ্কর মানুষটির মস্তকে বসে অপরূপ সুন্দরী নারী জোসনা জলে স্নান করছে। বড়ই আশ্চর্য হয় অরজিত।
ধারাবাহিক স্বপ্নের সে রাতে আর ঘুম আসে না অরজিতের। বারান্দায় এসে দাড়ায়। রাতের পৃথিবী এ নগরীতে স্থবির হয়ে আছে। একটি কাক পক্ষও নেই জেগে থাকার, একটি ঘুমন্ত শহর ছাড়া। দিনের আলোয় মানুষের কোলাহল। রঙ বেরঙের মানুষের বসবাস অথচ এই রাতের গভিরে একটি মানুষও নেই জেগে থাকার।
বেলকুনিতে পায়চারি করে কোন লাভ হয় না তার। অঘুমে শরীরটা বাতাসে দোলে; কৌশলে নিজেকে গুটিয়ে; হাই তোলে।
রাত বাড়ে। ঝিঝিদের ডাক অনেক আগেই থেমে গেছে; নগরীর কুকুরগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে অথচ অরজিত! ঘুমাতে পারে না। অবাঞ্চিত স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় ও অস্থির হয়ে ওঠে। পায়চারি করে। না, ঘুম আসে না। আধো আলো-অন্ধকারে বিছানায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়।
অরজিত অদূরে বসে আছে। শম্ভু হাত জোড় করে, হাটু গেরে বসে প্রার্থনা করছে। শম্ভুর এমন দৃশ্যে অরজিত আশ্চর্য হয় এই ভেবে যে, শম্ভু নগরীর কর্তা। তার হুকুম ছাড়া গাছের কাক ডাল থেকে নড়ে না। সেই শম্ভু হাত জোর করে বসে আছে।
হঠাৎ করে কিছু অমিয় বাণী ভেসে আসে। শব্দ চয়ন, বাচন ভঙ্গি অরজিতের ভাল লাগে। উৎসুক হয়ে খুজে বেড়ায়; সে বাণী কোনদিক থেকে ভেসে আসছে। অল্পক্ষণ পরে আবিস্কার হয় বেদীতে বসে সেই মানবী। যাকে স্নানরতাবস্থায় দেখে ভাললাগার সব ফুলের সুবাসে দুচোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। সেই মানবী এখানে!
অরজিত এগিয়ে যায়। অবুঝ বালকের মতো হাটু গেরে বসে পড়ে। দুহাত নত করে প্রার্থনা করে। তার প্রার্থনায় তাবৎ উপাসনালয় শান্ত হয়ে যায়। ঈশ্বর বেচা-কেনার এই মঞ্চে অরজিত বড়ই নগন্য, তবু প্রার্থনা করে- মাগো, কৃপা করো।
শান্ত শিতল কন্ঠ ভেসে আসে- ওঠো অরজিত। তুমি এখানে, কী চাই তোমার?
-যুগে যুগে তুমি বেদীতে বসে রাজত্ব করো পৃথিবীর আর আমি শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই। শতবর্ষ দাসত্ব আর শোষণের দায় ঠেলে; এখনো মানুষ শোষণের শিকার। আমি সেসব অবহেলিত মানুষের প্রতিনিধি। আমার নগরীতে শোকের মাতম। অভাব-অনটন, প্রতিটি ঘরে হাহাকার। তোমার শম্ভুর পদভারে পিষ্ট হচ্ছে আমার গোলাপ বাগান, শাপলা বিল, জুই-চামেলির মনোরম দৃশ্য। কৃপা করো মা।
-ওঠো অরজিত। তুমি তো জানো মানুষ মরণশিল। শম্ভুর মৃত্যু হবে?
-প্রাণের মৃত্যু অবধারিত কিন্তু ততোদিনে আমার নগরী মানব শূন্য হয়ে যাবে।
-কেন?
-শম্ভুর শরীর জুড়ে কিছু স্বার্থপর মানুষের বসবাস। নাকের ডগায়, কানের কাছে, কাধের উপর, বুক পকেটে যে যেখানে স্থান পেয়েছে। তাদের কান কথায় শম্ভুর হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে। তাদের প্রলোভনে, স্বার্থে প্রতিদিন শত শত মানুষ শম্ভুর পায়ের তলায় পিষ্ঠ হচ্ছে। শম্ভু সে দিকে ফিরেও তাকায় না। একটি স্বার্থের জন্য হাজারো প্রাণের বলি হচ্ছে। এই শোষণের হাত থেকে রক্ষা করো মা।
-ধ্বংস অনিবার্য।
জেগে ওঠে অরজিত। সে এতোক্ষণ স্বপ্নের ঘোরে আক্রামত্ম ছিল। কার ধ্বংস অনিবার্য! সীমাহীন বালিরেখায় দাগ টেনে যায় ও। স্বপ্নের ঘোর কাটে না। কে ওই মানবী? আমাকে চেনে! জনম জনম ধরে তার সাথে আমার সম্পর্ক। খুব পরিচিত মনে হয়। তার স্পর্শ অরজিত শরীরের কোষে কোষে অনুভব করে। রোমকূপের প্রতিটি বিন্দুতে তারই পরশ তবে কেন তাকে চিনতে পারবে না। তাহলে কী স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছে অরজিতের?
অরজিত স্মরণ করার চেষ্টা করে, না স্মৃতির সীমানা যতোদূর যায় তার মধ্যে এই মানবীর কোন দৃশ্য নাই যে, স্মৃতির পট থেকে তুলে নিয়ে আসবে।
পূর্বপুরুষের স্পর্শ; হবে হয়তো। সে অনুভূতি অরজিতের মনে পড়ে না। পিতামহের চেহারাটুকুও আবছা হয়ে আছে। জন্মের পর মা-বাবার আদর, স্পর্শ কতোটুকু পেয়েছে তা মনে পড়ে না। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই তো পথে পথে কাটিয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। মানবের ধর্মে মশগুল থেকেছে।
তাহলে এমন নগরী, পিচ্চি পিচ্চি মানুষ, দৈত্যাকার শম্ভু এসব কিসের প্রতিচ্ছবি? কিংবা সেই স্বপ্নের মানবী?
-আজ সন্ধ্যায় শম্ভুর মৃত্যু।
অদৃশ্য বাণী শুনে অরজিত চমকে ওঠে। এদিক ওদিকে তাকায়। সে ব্যতিত দ্বিতীয় কোন মানবের অসিত্মত্ব নেই। তাহলে কে বলল? সময়ের সাথে অদৃশ্যও কথা বলে।
অরজিত অপেক্ষা করে একটি সন্ধ্যা রাতের। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে শম্ভুর মৃত্যু ঘটবে। সে ভ্যানিস হয়ে যাবে, তার অস্তিত্ব বিলীন হবে; সে হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে যাবে এ পৃথিবী থেকে। তখন তার শরীরে ঝুলে থাকা সেইসব মানুষেরা আছড়ে পড়বে সমতলে। আহত হবে, পঙ্গু হবে; বেঁচে থাকার জন্য করূণা ভিক্ষ করবে। দৃশ্যটি দেখার মতোন।
অরজিতের ঘুমের রেশ কেটে যায়। আড়মোড়া ভাঙ্গে। ঘুমের ক্লান্তি দূর হয়। ভোরের দৃশ্য উপভোগ করে। দেখতে দেখতে সুন্দর একটি পৃথিবী ওর সামনে জেগে ওঠে। বুঝতেও পারেনি রাতের আধার কেটে গেলে সূর্যদয় হয়। এমন সুন্দর একটি সকাল তার জন্য অপেক্ষায় ছিল সে ভাবতেও পারেনি।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এসজে